কমিউটার ট্রেনের ছাদে দুর্বৃত্তদের আঘাতে নিহত জামালপুরের সাগরের বাড়িতে গত তিন দিন ধরে রান্না হয়নি। একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে তার পরিবার এখন দিশেহারা।
বৃহস্পতিবার সাগরের মৃত্যুর পর প্রতিবেশীদের দেয়া খাবার খাচ্ছেন তার মা, বাবা, ভাই, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও দুই মেয়ে।
ওই ঘটনায় নিহত জামালপুরের নাহিদের পরিবারকে শনিবার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন আর্থিক ও খাদ্যসহায়তা দিলেও সাগরের পরিবার এখনও কোনো সহায়তা পায়নি।
রোববার বিকেলে জামালপুর শহরের বাগেরহাটা এলাকায় সাগরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে অনেকটা শয্যাশায়ী মা হনুফা বেগম। সাগরের ছবি দেখে মাঝে মাঝেই ডুকরে কেঁদে উঠছেন তিনি। ছেলের আচার বিক্রির সরঞ্জাম গুছিয়ে দিন কাটছে তার।
স্বামীকে হারিয়ে অন্তঃসত্ত্বা মুসলিমার কান্নায় চারপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে আছে। দুই মেয়ে আর অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় যেন রাজ্যের মেঘ জমেছে তার মুখে।
সাগরের মৃত্যুতে দুই মেয়ে ও অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে রাজ্যের চিন্তা এখন মুসলিমার। ছবি: নিউজবাংলা
সাগরের মা হনুফা বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার বাবা সাগর রিকশা চালাইত, আচার বেচত, আবার মাঝেমধ্যে রাজমিস্ত্রির কাজও করত। সাগর যা ইনকাম করত, ওইডে দিয়েই সংসার চলত। এহন তিন দিন ধইরে আমার বাবা নাই, তিন দিন ধইরে আমার চুলাও জ্বলে না।
‘পাড়ার লোকেরা যা দিতাছে তাই খাইয়ে বাঁইচে আছি। এহন সরকার যদি সাহায্য না করে তাইলে আঙ্গর মরণ লাগব।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার বাবারে যারা মারছে তাগোর সবার ফাঁসি চাই। আমার মতো আর কোনো মায়ের বুক যাতে খালি না হয়। আমার বাবারে হারায়ে আমি যেমন পাগল হয়ে গেছি। আর কেউ যাতে এমন পাগল না হয়।’
সাগরের বাবা হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। দুই মেয়েরে বিয়ে দিয়ে দিছি। বড় ছেলে সাগর কামাই কইরে সংসার চালাইত।
‘বুধবার আমার বড় মেয়ে হাসি আক্তারকে ঢাকায় রেখে বৃহস্পতিবার সাগর জামালপুরের উদ্দেশে রওনা দেয়। রাতে না আসলে পরে আমরা খবর নিয়ে দেখি হাসপাতালে লাশ পইড়ে আছে। আমি আমার বাবারে সারা জীবনের জন্য হারায় ফালাইছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘তিন দিন ধইরে প্রতিবেশীরা যা দিতাছে তাই খাইতাছি। প্রতিবেশীরা আর কত দিন এইভাবে খাওয়াব। আমার পক্ষেও রোজগার করা সম্ভব না। এহন সরকার যদি আঙ্গরে সাহায্য না করে, তাহলে আঙ্গর সবার মরা ছাড়া উপায় নাই।’
সাগরের স্ত্রী মুসলিমা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি আগে থেকেই এতিম। আমার বাবা-মা কেউ নাই। এহন আমার দুইটা মেয়েবাচ্চাও এতিম হয়ে গেল। আমার গর্ভের সন্তানটা ওর বাবার মুখ দেখবার পাইল না। এই দুঃখ আমি কই রাখমু। আমার এত বড় ক্ষতি যে করল তাগোর ফাঁসি চাই।’
পরিবারটির প্রতিবেশী রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘সাগর মরার পরে আমরাই এই পরিবারকে খাওয়া দিতাছি, কিন্তু এইভাবে আর কতদিন দিব। আমরাও তো গরিব মানুষ। এহন সরকারের উচিত এই পরিবারটারে সাহায্য করা।’
সাগরের ছবি হাতে মা হনুফা
জামালপুরের মানবাধিকারকর্মী জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, ‘এমন ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা সব সময় দেখি স্থানীয় প্রশাসন খুব দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহায়তা করে। ঘটনার পরদিন দেওয়ানগঞ্জের নাহিদের পরিবারকে সহায়তা দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। তবে জামালপুরে সাগরের পরিবারকে এখনও কোনো সহায়তা করা হয়নি। আমরা অতি দ্রুত সাগরের পরিবারকে সহায়তার দাবি জানাই।’
জামালপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা লিটুস লরেন্স চিরান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নিহত সাগরের পরিবারকে আমরা আর্থিক সহায়তা দেব। আগামীকাল সদরের এমপি মোজাফফর স্যারের উপস্থিতিতে ২০ হাজার টাকা ও ১০ কেজি চাল সাগরের পরিবারকে দেয়া হবে। এমপি স্যার একটু ব্যস্ত থাকায় আজ দেয়া সম্ভব হয়নি।’
বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জগামী কমিউটার ট্রেনটি রাতে ময়মনসিংহে পৌঁছালে ট্রেনের ছাদে থাকা দুর্বৃত্তদের আঘাতে প্রাণ হারান জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের নাহিদ ও শহরের বাগেরহাটা এলাকার সাগর।
ওই ঘটনায় শুক্রবার রাতে সাগরের মা হনুফা ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় ময়মনসিংহ রেলওয়ে পুলিশ দুজনকে এবং র্যাব পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে।