সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর নির্ভর করে যারা সংসার চালান, তাদের জন্য দুঃসময়। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে দিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে ২১ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, যারা ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবেন, তাদের ক্ষেত্রে মুনাফা অপরিবর্তিত থাকবে। তবে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ হলে আগের চেয়ে কম হারে মুনাফা পাবেন।
এ ছাড়া ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের মেয়াদি হিসাব এবং সবচেয়ে বেশি মুনাফার ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডের হারেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। মুনাফা কমানো হয়েছে গড়ে ১ থেকে ২ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, অনেক অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী ও মধ্যবিত্ত সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর নির্ভরশীল। সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে তাদের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়বে।
প্রথমবারের মতো সরকার মুনাফা হারের আলাদা স্তর করেছে। সঞ্চয় স্কিমের স্তর করেছে তিনটি। ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে মুনাফা অপরিবর্তিত থাকবে। ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফা কমবে ১ শতাংশ। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফা কমবে ২ শতাংশ।
অর্থাৎ কম টাকার বিনিয়োগকারীর মুনাফার হার বেশি, আর বেশি টাকার বিনিয়োগকারীর মুনাফার হার কম।
যারা নতুন করে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবেন, শুধু তাদের জন্য পরিবর্তিত হার কার্যকর হবে। অর্থাৎ এই প্রজ্ঞাপনের আগে যারা সঞ্চয়পত্র কিনেছেন, তাদের ক্ষেত্রে নতুন হার কার্যকর হবে না।
সবশেষ ২০১৫ সালে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো হয়েছিল।
সুদহার পুনর্নির্ধারণ প্রসঙ্গে সরকার বলছে, সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকে পড়ায় ব্যাংক খাতে আমানতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সরকারের ঋণের বোঝা কমানো, আমানতের স্বাভাবিক পরিস্থিতি বজায় রাখাসহ সামগ্রিকভাবে ভারসাম্য রক্ষায় বেশি বিনিয়োগের সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমানো হয়েছে। এতে করে সরকারের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় কিছুটা কমবে।
গত অর্থবছরে মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। আর গত জুন পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রে মানুষের মোট বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সুদ ব্যয় বেড়ে চলেছে, যা সরকারের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে। মূলত সঞ্চয়পত্রে লাগাম টেনে ধরতে সুদহার পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।’
অর্থ মন্ত্রণালয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একক খাত হিসেবে বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দ এখন সুদ পরিশোধে। গত অর্থবছরে সুদ বাবদ ব্যয় হয় প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়বেন সঞ্চয়কারীরা। তবে বেশি বিপাকে পড়বেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, নারী ও মধ্যবিত্ত নাগরিক। কারণ, সমাজের বিশাল এই জনগোষ্ঠী বহুলাংশে সঞ্চয়পেত্রর আয়ের ওপর নির্ভরশীল।
তারা বলেছেন, করোনাকালে এমনিতেই অনেক মানুষ কষ্টে আছে। আবার দেশে নিরাপদ বিনিয়োগের বিকল্প কম। অবসরপ্রাপ্ত ও বয়স্ক অনেকের একমাত্র আয় সঞ্চয়পত্র। সরকারের এ সিদ্ধান্তে তাদের আয় কমে যাবে। ফলে জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়বে।
বর্তমানে খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, পোশাক-পরিচ্ছদ, জিনিসপত্রের দামসহ জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক গুণ বেড়েছে। এ অবস্থায় সঞ্চয় থেকে আয় কমলে স্বল্প ও নির্ধারিত আয়ের মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজধানীর শ্যামলীর বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী আব্দুর রহমান সরকারের এ সিদ্ধান্তে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের বাঁচার কোনো পথ আর রইল না। পেনশনের টাকার একটি অংশ দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনার ইচ্ছা ছিল। সুদহার কমায় সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলাম।’
আগারগাঁওয়ের গৃহিণী হামিদা বানু বলেন, ‘ব্যাংকে টাকা রাখলে সুদ পাওয়া যায় না। কিছুদিন আগে সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর বাড়ানো হয়েছে। এখন মুনাফার ওপর কর কমানো হলো। আমাদের মতো মধ্যবিত্তের জন্য সঞ্চয়পত্র ছিল একমাত্র আয়ের ভরসা। সরকার এখানে হাত দিয়েছে। করোনাকালে বেঁচে থাকটাই কষ্ট হয়ে পড়েছে।’
রাজধানীর তালতলার অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক রাশিদুল হাছান বলেন, ‘সঞ্চয়পত্রে ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে কর কর্তনের পর মাসে ১৫-১৬ হাজার টাকা পাওয়া যায়। এই টাকা দিয়ে ঢাকা শহরে একটি মধ্যবিত্ত পরিবার কি চলতে পারে?’
আগারগাঁওয়ের সরকারি কলোনীর শাহাবউদ্দিন বলেন, ‘২০ বছর চাকরি করেছি। চাকরিজীবনের সঞ্চয়ের অর্থ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছি। সেই মুনাফার অর্থে কোনো রকম সংসার চালিয়ে নিচ্ছিলাম। সরকার এখন সঞ্চয়পত্রে সুদ কমিয়ে দিল। মুনাফা কমে গেলে হয় আমাকে খরচ কমাতে হবে, নয়তো হাত পাততে হবে।’
অর্থমন্ত্রী বুধবার ক্রয় কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, সুদহার কমানোর ফলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক ঊর্ধ্বতন পরিচালক বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘সঞ্চয়পত্রে বেশি বিনিয়োগ করে অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী, নিম্ন আয়ের মানুষ ও মধ্যবিত্তরা। এ ধরনের নাগরিকদের স্বার্থ বিবেচনায় সুদহার না কমালেই ভালো হতো।’