দিনাজপুরের বীরগঞ্জে সাড়ে সাত কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করিয়ে সেই টাকা কৃষকদের না দেয়ার অভিযোগ উঠেছে সোলারগাঁও অ্যাগ্রো ইঞ্জিনিয়ার্স এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এটি ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট।
এ ঘটনার প্রতিবাদ করায় চাকরিচ্যুত করার অভিযোগ তুলেছেন প্রতিষ্ঠানটির আট কর্মকর্তা।
এরইমধ্যে টাকা লোপাটের ঘটনায় বীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন কয়েকজন কৃষক ও পাম্প অপারেটর।
অভিযোগে বলা হয়েছে, সোলারগাঁও অ্যাগ্রো ইঞ্জিনিয়ার্স এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড ব্যাংক এশিয়ার মাধ্যমে কৃষকদের কৃষি ঋণ দেয়ার কথা বলে তাদের অগোচরে একটি করে নতুন সিম রেজিস্ট্রেশন করে। ওই সিম নম্বরে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তৈরি করে কয়েকশ মোবাইলে সিমগুলো চালু রাখা হয়।
এতে বলা হয়েছে, প্রতি কৃষকের বিপরীতে ৫০ হাজার টাকা করে ঋণ পাস হলেও কৃষকরা পেয়েছেন পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা। অথচ ওই কৃষকদের ৫০ হাজার টাকার ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। আবার কারও নামে ৫০ হাজার টাকা ঋণ পাশ হলেও কৃষকরা কোনো টাকাই পাননি।
কৃষকদের অভিযোগে বলা হয়েছে, এভাবে বীরগঞ্জ, কাহারোল, বিরল, খানসামা, বোচাগঞ্জ ও পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার কয়েকশ কৃষককে ঠকিয়ে প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকা লোপাট করেছে সোলারগাঁও অ্যাগ্রো ইঞ্জিনিয়ার্স এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড।
কাহারোলের উত্তর নওগাঁ গ্রামের গভীর নলকূপের অপারেটর সমারু মালাকার বলেন, ‘২০২০ সালের প্রথম দিকে সোলারগাঁও অ্যাগ্রোর লোকজন আমার জমিতে একটি ডিপ মেশিন বসানোর জন্য আসে। তাদের সঙ্গে চুক্তি হয়।
‘চুক্তি অনুযায়ী আমার জমি থেকে ১৫ শতক নিয়ে তাদের বছরে ২০ হাজার টাকা দেয়ার কথা। এছাড়াও প্রতিমাসে তারা আমাকে তিন হাজার টাকা বেতন ও পাম্প থেকে আয়ের ২০ শতাংশ টাকা কমিশন হিসেবে দিতে চায়। প্রথম দুই মাস তারা প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা দিয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘এরপর থেকে তারা আমার বেতন বন্ধ করে। পরে সোলারগাঁও অ্যাগ্রোর লোকজন আমার কাছে এসে ওই গ্রামের কৃষকদের কৃষি ঋণ দেয়া হবে বলে জানায়। পরে আমি তাদের ৮০ জনের তালিকা দিই। তাদের লোকজন গ্রামে এসে ৮০ জনের নামে ঋণ প্রস্তাব করে নিয়ে যায়।’
সমারু মালাকার বলেন, ‘এসময় তাদের সঙ্গে দুটি করে ল্যাপটপ ছিল। একটি ল্যাপটপে ঋণ নেয়ার জন্য প্রতি কৃষকের ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়েছিল। অপরটিতে ফিঙ্গারপ্রিন্টসহ কৃষকের মোবাইল নম্বর নেয়। পরে আমরা জানতে পারি আমাদের অগোচরে অপর ল্যাপটপে ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে কৃষকদের নামে একটি করে নতুন সিম রেজিস্ট্রেশন করে তারা। ওই সিমগুলো কোম্পানির হেফাজতে ছিল।
‘কিছুদিন পর কর্তৃপক্ষ আমাকে জানায়, ৮০ জনের ঋণ প্রস্তাবের মধ্যে মাত্র ১০ জনের ১০ হাজার টাকা করে ঋণ মঞ্জুর হয়েছে। অথচ যাদের নামে ঋণ মঞ্জুর হয়েছে, তারা মোবাইলে কোনো মেসেজ পায়নি। তারা ৮০ জনের নামে ঋণ পাস করিয়ে ১০ জন কৃষককে ১০ হাজার টাকা করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘১০ জন কৃষক ঋণের টাকা তাদের কাছে নিয়ে আবার কিস্তিতে পরিশোধ করেছে। তবে অনেক কৃষকের মোবাইলে নম্বরে মেসেজ আসছে ৫০ হাজার টাকা পরিশোধের। আমাদের এখন পথে বসার মতো অবস্থা।’
সমারু জানান, একইভাবে কাহারোলের শংকরপুর গ্রামের পাম্প অপারেটর জুয়েল ইসলামের মাধ্যমে ৬০ জন, মাধবগাঁও গ্রামের পাম্প অপারেটর যতীশ চন্দ্র রায়ের মাধ্যমে ৯০ জন, রসুলপুর গ্রামের পাম্প অপারেটর রহিদুল ইসলামের মাধ্যমে ৩০ জনসহ বিভিন্ন উপজেলায় পাম্প অপারেটরদের মাধ্যমে কয়েকশ কৃষকের নামে ঋণ প্রস্তাব করে ওই টাকা লোপাট করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
অভিযোগ রয়েছে, এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় প্রতিষ্ঠানের আট কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করেছে সোলারগাঁও অ্যাগ্রো ইঞ্জিনিয়ার্স এন্টারপ্রাইজ।
এ বছরের ১৯ আগস্ট প্রতিষ্ঠানের কালেকশন অ্যান্ড লোন রিকোভারি অফিসার পদ থেকে মো. জীবন, শামীম ইসলাম, বিল্লাল আলী, আল মামুন ও নুরুল ইসলাম নামে পাঁচ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করে সোলারগাঁও অ্যাগ্রো।
এর আগে এক সঙ্গে চাকরিচ্যুত করা হয় আব্দুল্লাহ আল মামুন, ফাতাউর ইসলাম ও আবুল বাসার নামে আরও তিন কর্মকর্তাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা বলেন, ‘কৃষকদের টাকা আত্মসাতের বিষয়টি বুঝতে পেরে আমরা এর প্রতিবাদ করি। পরে বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে আমাদের চাকরিচ্যুত করে কর্তৃপক্ষ।
‘আমরা তাদের কাছে বেতনসহ বিভিন্ন খাতের বহু টাকা পাব। তারা ওই টাকাও দিচ্ছে না। কৃষকদের মতো আমরাও এখন রাস্তায় বসে গেছি। এমনকি তাদের অপকর্মের বিষয়ে কাউকে যেন না বলি সেজন্য নানাভাবে হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘ধীরে ধীরে নিজেদের অফিসের জিনিসপত্র অন্য জায়গায় সরিয়ে নিচ্ছে সোলারগাঁও অ্যাগ্রো। এখন প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ছাড়া আর আমাদের বাঁচার পথ নেই।’
জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগের পর ঘটনাটি তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বীরগঞ্জের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু রেজা আসাদুজ্জামানকে।
তিনি বলেন, ‘আমি ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছি। শিগগিরই প্রতিবেদন দেয়া হবে।
বীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল কাদের বলেন, ‘অভিযোগ পাওয়ার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ব্যাংক এশিয়া দিনাজপুর শাখার ম্যানেজার চঞ্চল কুমার বলেন, ‘কয়েক দিন আগে আমরা বীরগঞ্জ এজেন্ট সোলারগাঁও অ্যাগ্রোর বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ জানতে পেরেছি। আমি বিষয়গুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। লিখিত অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
অভিযোগের বিষয়ে সোলারগাঁও অ্যাগ্রো ইঞ্জিনিয়ার্স এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের ম্যানেজার বুলবুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এখানে কয়েজন কর্মকর্তাকে আর্থিক অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলাও হয়েছে। এরপর থেকে তারা সোলারগাঁও অ্যাগ্রোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের কাগজপত্র দেখতে চেয়েছে উপজেলা প্রশাসন। আমরা সময় মতো তাদের কাগজপত্র দেখাব। আমাদের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।’
ম্যানেজার বুলবুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে কৃষকদের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। অথচ আমরা যে কৃষকদের ঋণ দিয়েছি, তারা আবার ঋণের টাকা ফেরত দিয়েছে।’