ছয় বছর আগে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী ঈগল পরিবহনের বাসে রেখে যাওয়া একটি ট্রাঙ্ক থেকে এক তরুণীর মৃতদেহ পাওয়া যায়। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে বেরিয়ে এসেছে খুলনার দৌলতপুরের তরুণী শম্পা বেগমকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে ট্রাঙ্কে ভরে বাসে তুলে দেন তারই কথিত স্বামী নৌবাহিনীর তৎকালীন মেডিক্যাল সহকারী রেজাউল করিম স্বপন।
পিবিআই এর একটি দল শুক্রবার (২৪ সেপ্টেম্বর) কুমিল্লা ইপিজেড থেকে রেজাউল করিম স্বপনকে গ্রেপ্তার করে। স্বপন আদালতে দেয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে হত্যার কথা স্বীকার করেন।
পিবিআই-এর উপ-মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার শনিবার ধানমন্ডির প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান।
পিবিআই উপ-মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার ধানমন্ডির প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন। ছবি: নিউজবাংলা
বাসের লকারে ট্রাঙ্কবন্দি মৃতদেহ
২০১৫ সালের ২ মে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকার একটি বাসায় শম্পাকে ওড়না দিয়ে পেছিয়ে শ্বাসরোধে হত্যার পর নিজের দায় এড়াতে পরিকল্পনা করেন স্বপন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, শম্পার মরদেহ তারই একটি হলুদ ট্রাঙ্গে ঢুকিয়ে ৩ মে শহরের এ কে খান মোড়ে রিকশায় করে নিয়ে আসেন স্বপন। সেখানে ঈগল পরিবহনের কাউন্টারে গিয়ে ঢাকাগামী একটি টিকেট কেটে ট্রাঙ্কটি তুলে দেন বাসের লকারে।
স্বপন বাসের হেলপারকে বলেন, সামনের ভাটিয়ারী কাউন্টার থেকে এই টিকেটের মহিলা যাত্রী উঠবেন। তাকে যেন ভালোভাবে ঢাকা নামিয়ে দেয়। কিন্তু পরবর্তী কাউন্টারে যাত্রী না উঠায় বাসটি ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করে এবং বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটে গাবতলীতে পৌঁছায়। শেষ গন্তব্যে সকল যাত্রী যে যার মতো তাদের জিনিসপত্র নিয়ে নেমে যায়।
হেলপার দেখতে পান, একটি ট্রাঙ্ক বাসের লকারে মালিকবিহীন পড়ে আছে। তখন বাসের চালক ও হেলপার মিলে ট্রাঙ্কটি লকার থেকে বের করেন এবং বুঝতে পারেন এটি খুবই ভারী। তাদের সন্দেহ হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে দারুসসালাম থানায় খবর দিলে থানা পুলিশ হাজির হয়ে ট্রাঙ্কটি খুলে এবং মরদেহ দেখতে পান। অজ্ঞাত হিসেবে মৃতদেহটির সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়। মৃতদেহের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় অজ্ঞাত পরিচয়ে দাফন করা হয়।
কেউ বাদী না হওয়ায় থানা পুলিশের পক্ষে উপপরিদর্শক (এসআই) জাহানুর আলী বাদী হয়ে আসামি অজ্ঞাত উল্লেখ করে দারুস সালাম থানায় মামলা করেন।
তদন্তে থানা ও সিআইডি ব্যর্থ হলেও সফল পিবিআই
মামলাটি হওয়ার পর থেকে শুরুতে প্রায় তিন মাস থানা পুলিশ তদন্ত করে। থানা পুলিশের পরে সিআইডি দীর্ঘ চার বছর তদন্ত করে। কিন্তু মৃতদেহের পরিচয় শনাক্ত এবং হত্যা রহস্য উন্মোচিত না হওয়ায় আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি।
চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ না করে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মামলার তদন্তভার পায় পিবিআই। ঢাকা মেট্রো (উত্তর) মামলার তদন্ত করে।
ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদারের নির্দেশে পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) উক্ত মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে। ঢাকা মেট্রো (উত্তর) বিশেষ পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলমের তত্বাবধানে পরিদর্শক আশরাফুজ্জামান মামলাটি তদন্ত করেন।
যেভাবে শনাক্ত হয় তরুণীর পরিচয়
পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার জানান, ভিকটিমকে শনাক্ত করার জন্য প্রচলিত সকল পদ্ধতি প্রয়োগ করে। চট্টগ্রাম মেট্রো এবং জেলা এলাকার সকল থানায় বিগত ২০১৫ সালে করা নিখোঁজ জিডিগুলো অনুসন্ধান করে তথ্য নিয়ে আসার জন্য পাঠানো হয় তদন্তকারী কর্মকর্তাকে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা এক সপ্তাহ নিরলস পরিশ্রম করে ঐ সময়ের কাছাকাছি প্রায় ১০-১২টি নিখোঁজ জিডির তথ্য উদঘাটন করেন। জিডিগুলোর মধ্যে ২০১৫ সালের ১০ জুন করা একটির সন্ধান পান তিনি। যাতে দেখা যায়, শম্পা বেগম নামে এক তরুণী চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। নিখোঁজের ঘটনায় শম্পা বেগমের ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নান পাহাড়তলী থানায় জিডিটি করেন।
তদন্তকারী কর্মকর্তা জিডিকারী আব্দুল মান্নান এবং শম্পার বাবা ইলিয়াস শেখের (অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য) সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, ২০১৩ সালে রেজাউল করিম স্বপন (অবসরপ্রাপ্ত নৌ বাহিনী সদস্য) খুলনা তিতুমীর নৌঘাঁটিতে কর্মরত থাকা অবস্থায় শম্পা বেগমের সঙ্গে পরিচয় হয়। এই পরিচয়ের সূত্রে প্রথমে প্রেম এবং পরে ভিকটিম তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিলে স্বপন বদলি হয়ে চট্টগ্রামে চলে যান।
ভিকটিম শম্পাও কিছুদিন পরে চট্টগ্রামে চলে যান। চট্টগ্রামে শম্পার এক ফুপুর বাসায় কিছুদিন থাকেন দুজন। এরপর ফয়েজ লেক এলাকায় একটি হোটেলে কিছুদিন অবস্থান করে এই যুগল। পরে পাহাড়তলীর উত্তর গ্রিনভিউ আবাসিক এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য আনোয়ার হোসেনের টিনশেড বাড়ির একটি বাসায় সাবলেট নিয়ে তারা বসবাস শুরু করেন।
এভাবে তারা ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালের মে পর্যন্ত একত্রে বসবাস করেন। তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করলেও বিয়ে করেননি।
পিবিআই প্রধান বনজ কুমার জানান, পরবর্তীতে তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য দেখা দিলে আসামি রেজাউল করিম স্বপন শম্পাকে ২০১৫ সালে ২ মে গভীর রাতে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। মৃতদেহ গোপন করার উদ্দেশে একটি ট্রাঙ্কে ভরে ঢাকাগামী ঈগল পরিবহনের একটি বাসে তুলে দেন স্বপন এবং সুচতুরভাবে ভিকটিমের বাবাকে জানান, শম্পাকে খুলনার বাসে তুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে ভিকটিম তার বাবার বাড়িতে না পৌঁছলে তারা বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে ভিকটিমের ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নান পাহাড়তলী থানায় নিখোঁজ জিডিটি করেন।
এই জিডির সূত্র ধরেই নিহতের পরিচয় ও আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান পিবিআই প্রধান বনজ কুমার।
আসামি রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে নৌবাহিনী চট্টগ্রাম অফিসে শম্পার বাবা একটি লিখিত অভিযোগ করেন। তবে সে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি বলা হয় নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে। দ্বিতীয় দফায় নৌবাহিনীতে আবার অভিযোগ করেন শম্পার বাবা। তখন চাকরির বয়স ১৯ পার হওয়ায় ২০১৯ সালে স্বপনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় নৌবাহিনী। তবে মেয়ে নিখোঁজের সুরাহা পাননি শম্পার বাবা।
শম্পার বাবা ইলিয়াস শেখ বলেন, ‘ছয় বছর ধরে আমার মেয়ে নিখোঁজ ছিল। কোথায়, কী হয়েছে, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমার মেয়ে স্বপনকে বিয়ে করার কথা জানিয়েছিল। কয়েকদিন আগে পিবিআই জানিয়েছে, আমার মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল গাবতলীতে। কালকে (শুক্রবার) শুনলাম স্বপনকে গ্রেপ্তার করেছে। আমার মেয়েকে হত্যার বিচার চাই।’