দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগে ভুগছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান। নরসিংদীতে নিজ এলাকায় এক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। গত বুধবার হঠাৎ তার অবস্থার অবনতি হয়।
তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়ায় আজিজুর রহমানকে দ্রুত ঢাকার হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। রোগীর স্বজনরা তাৎক্ষণিকভাবে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে রাজধানীর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন।
চিকিৎসকরা প্রথমে রোগীকে ভর্তি নিতে অনীহা প্রকাশ করেন। রোগীর স্বজনদের তারা বলেন, চিকিৎসা নেয়ার আগে করোনা পরীক্ষা করতে হবে। রোগীর স্বজনদের অনুনয়-বিনয়েও কর্তব্যরত চিকিৎসকদের মন গলেনি। একপর্যায়ে তারা জানিয়ে দেন কোভিড পরীক্ষা ছাড়া কোনো রোগীর চিকিৎসা হবে না।
আজিজুরের দুই ডোজ করোনা প্রতিরোধী টিকা নেয়ার সনদ সঙ্গেই ছিল। এর পরও সংকটাপন্ন এই রোগীকে দ্রুত মহাখালী কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন ইব্রাহিম কার্ডিয়াকের চিকিৎসকরা।
তবে অ্যাম্বুলেন্সে পর্যাপ্ত অক্সিজেন মজুত ছিল না। অ্যাম্বুলেন্সচালক রোগীর স্বজনকে জানান, যে অক্সিজেন আছে, সেটা দিয়ে ৪০ মিনিট রোগীকে অক্সিজেনের আওতায় রাখা সম্ভব হবে।
যানজটের কারণে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক থেকে ডিএনসিসির করোনা হাসপাতালে আসতে সময় লাগে ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট। রাস্তায় রোগীর মৃত্যু ঘটে। ডিএনসিসি হাসপাতালে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসক বলছেন, তাদের হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার জন্য আলাদা কোনো ইউনিট নেই। আজিজুর রহমানের করোনা উপসর্গ ছিল, সেই কারণে করোনা পরীক্ষা করার কথা বলা হয়। সেই সঙ্গে র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের সুযোগ নেই হাসপাতালে, যা দিয়ে আধা ঘণ্টায় করোনা পরীক্ষা করা যেত।
শুধু আজিজুর রহমান নন, বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে নন-কোভিড (অন্য রোগে আক্রান্ত) সংকটাপন্ন রোগীদের এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যথাসময়ে প্রয়োজনীয় জরুরি চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এসব রোগী। এমন পরিস্থিতিতে রীতিমতো দিশেহারা সাধারণ মানুষ।
রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পথে। ডেঙ্গু পরিস্থিতিও অনেকটা স্থিতিশীল। এর মধ্যে মৌসুমি জ্বর ও সর্দি দেখা দিয়েছে। এসব কারণে সাধারণ রোগীর চাপ বেড়েছে হাসপাতালগুলোতে। এমন বাস্তবতায় সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। ফলে আগে কোভিড টেস্ট, পরে যেকোনো রোগের চিকিৎসা- এমন নীতিতে জরুরি সেবা থেকে বিরত থাকছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা।
একই নীতির কারণে জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলায় প্রসববেদনা নিয়ে পরপর তিনটি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা না পেয়ে আল্পনা নামের এক প্রসূতির মৃত্যু এবং এক প্রসূতির ক্লাবে সন্তান প্রসবের ঘটনা ঘটে।
এসব ঘটনার পর নাগরিকদের জরুরি চিকিৎসাসেবা দিতে হাসপাতালগুলো বাধ্য বলে উল্লেখ করেছে হাইকোর্ট। কোনো হাসপাতাল অসম্মতি জানাতে পারবে না বলেও জানানো হয়েছে। ১২ সেপ্টেম্বর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়।
সেই সঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের আচরণ কোনোভাবে কাম্য নয়। কোভিড, নন-কোভিড সব রোগীর চিকিৎসা সমভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, চিকিৎসকদের দায়িত্ব করোনা, নন-করোনা সব রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করা। করোনা পরীক্ষার জন্য চিকিৎসা বন্ধ রাখতে হবে- এমন কোনো কথা নেই। এ ক্ষেত্রে দ্রুত পরীক্ষার জন্য সব হাসপাতালে করোনা পরীক্ষায় র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের ব্যবস্থা রাখতে হবে। অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে করোনার কারণে নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা যাতে ব্যাহত না হয়।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুুুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার মধ্যে অন্যান্য সেবাও অব্যাহত রাখতে হবে। একই সঙ্গে চিকিৎসদের নিরাপত্তার জন্য করোনা পরীক্ষা করানো হয়। তবে করোনা পরীক্ষার সনদের অপেক্ষায় চিকিৎসাসেবা পাবে না সাধারণ মানুষ, এমনটা হতে পারে না।
‘এ বিষয়ে অবশ্যই চিকিৎসকদের সদয় হতে হবে। এ সমস্যা সমাধানে ইতিমধ্যে অনেক হাসপাতালে এখন র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওখানে ৩০ মিনিটের মধ্যে ফল পাওয়া যাবে। আমি সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের চিকিৎসকদের বলব, তারা যেন এ বিষয়ে মানুষের প্রতি মানবিক হন। এ ছাড়া এ সমস্যা সমাধানে র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করার জন্য নতুন ৩০টি মেশিন কেনার প্রস্তুতি চলছে।’