উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন দৈনিক ভোরের ডাকের স্টাফ রিপোর্টার ইমরুল কাওছার ইমন। ২০১৯ সালে স্বল্প পরিসরে ‘খাকি ক্যাম্পেবেল’ জাতের হাঁস পালনের পরিকল্পনা করেন। তা বাস্তবায়নে করোনা মহামারির মাঝামাঝি সময়ে গড়ে তোলেন হাঁসের খামার।
হাঁসের ডিম বিক্রির আয়ে ৪ একর জমির তিনটি পুকুরে তিনি এখন পরিকল্পিতভাবে চাষ করছেন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। চার মাস পর পর মাছ বিক্রি থেকে আয় হচ্ছে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক টাকা।
ইমনের বাড়ি গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের পশ্চিম খামার দশলিয়া গ্রামে। নিজস্ব জমিসহ কয়েক বিঘা জমি বর্গা নিয়ে মাছ চাষ ও হাঁসের খামার করেছেন তিনি। খামারে এক হাজার হাঁসের মধ্যে প্রতিদিন তিনি সাত থেকে আটশ ডিম সংগ্রহ করছেন। এই ডিম বিক্রির টাকায় হাঁস ও মাছের দৈনিক ছয় হাজার টাকার খাদ্যসহ শ্রমিকদের বেতন দিয়েও মাসে তার আয় হচ্ছে প্রায় লক্ষাধিক টাকা।
রাজধানী ঢাকায় সাংবাদিকতার পাশাপাশি নিজ এলাকায় গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরে বিশাল মৎস্য ও হাঁসের খামার গড়ে তুলেছেন ইমন। খামারে হাঁসের সংখ্যা হাজারেরও বেশি। সমন্বিতভাবে ১২ বিঘা জমিতে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছেন দেশি-বিদেশী মাছ। দুই খামারে প্রতিদিন গড়ে খরচ হচ্ছে প্রায় ছয় হাজার টাকা। যার বেশিরভাগই আসে ডিম বিক্রির টাকা থেকে।
ছোট বেলা থেকেই ইমনের মন টানতো কৃষিতে। ভিন্ন বিষয়ে পড়ালেখা করেও কৃষিভিত্তিক কিছু একটা করার স্বপ্ন ছিল তার। ঢাকায় চারটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক এই তরুণ উদ্যোক্তা।
তবে তার একটা গল্প আছে। হঠাৎ বৈশ্বিক করোনা মহামারিতে তার চারটি প্রতিষ্ঠান যখন অন্ধকারে; ঠিক তখনই কৃষিতে সফলতা এসেছে তার। এই খামারই এখন তার টিকে থাকার প্রধান অবলম্বন।
বাণিজ্যিকভাবে হাঁস ও মাছ চাষের পাশাপাশি ইমরুল কাওছার ইমন ২০১৫ সালে ঢাকার গুলিস্থানে নিজের জমানো টাকা দিয়ে একটি ছোট্ট শার্ট তৈরির কারখানা শুরু করেন। তিন জন কর্মচারী নিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে ৫০ জনের বেশি লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে তার কারখানায়। শান্তিনগরে একটি ট্রাভেল এজেন্সিও আছে। তাছাড়া ব্যবসার লাভের টাকায় বেশ কয়েকটি মাইক্রোবাস কিনে রাজধানীতে উবারেও চালান তিনি।
একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন ক্লাব ভিত্তিক টুর্নামেন্টসহ বাংলাদেশ জাতীয় দলের খেলোয়ারদের জার্সি ও গ্যালারিতে ব্র্যান্ডিংয়ের (বিজ্ঞাপন) কাজ করেও সফলতা পেয়েছেন তিনি।
তবে চলতি বছরের মার্চে এসে তার জীবনের হিসেব এলোমেলো হয়ে যায়। বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রকোপে ক্ষতি শুরু হতে থাকে একের পর এক ব্যবসায়। লকডাউনে গার্মেন্টস-কারখানা বন্ধ। উবারের গাড়ির চাকাও ঘোরেনি। সারা বিশ্বে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ায় ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা ও ক্রিকেট ব্র্যান্ডিংও বন্ধ হয়ে যায়।
- আরও পড়ুন: হাঁসে হাসছেন ট্রান্সজেন্ডার খুকুমনি
ঠিক তখনই ইমরুল উপলব্ধি করতে পারেন, কয়েক বছরের চেষ্টার ফল করোনার এক ধাক্কায় স্থবির হয়ে গেল। এই হতাশার মধ্যে কৃষি ভিত্তিক কিছু করার পরামর্শ দেন তার সহধর্মিণী।
পরবর্তীতে সমন্বিতভাবে হাঁস ও মাছ চাষের পরিকল্পনা করেন ইমন। গুগল ও ইউটউব দেখে ও স্থানীয় খামারিদের কাছে পরামর্শ নিয়ে ‘হামিদা ডাক এন্ড ফিস ফার্ম’ গড়ে তোলেন। খামার দেখভাল করেন ছোট ভাই নাহিদ আনছারী।
তিনি বলেন, ‘আমরা এই খামারটি তৈরি করেছি মূলত আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে। তাছাড়া এই খামার করে আমরা লাভবানও হচ্ছি।’
স্থানীয়রা জানায়, ইমরুল কাওছার ইমনের খামারে চার-পাঁচ জন শ্রমিক রয়েছে। একটি পুকুরে এক পাশে চাষ করছেন তেলাপিয়া ও আরেক পাশে থাই জাতের পাংগাস। তার পাশে পানির উপরে বাঁশ ও টিন দিয়ে মাচা বানিয়ে হাঁসের খামার করেছেন।
এছাড়া আরেকটি পুকুরে চাষ হচ্ছে ভিয়েতনামী কই, হাইব্রিড সিং, বিদেশি মৃগেল, কালিবাউশ, মিরকার্প ও সরপুঁটি। অপরটিতে চাষ হচ্ছে দেশী মাছ। এর সবগুলোই বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে এই খামারে।
এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে স্থানীয় সংবাদকর্মী শাহিন মিয়া বলেন, ‘ইমন ঢাকায় সাংবাদিকতা করলেও এলাকার বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেন। মূলত বেকারদের কর্মমূখী করার চিন্তা থেকেই তার এই হাঁস ও মাছের খামার করা। এরই মধ্যে তার সফলতা দেখে আশেপাশে প্রায় ১০-১৫টি নতুন খামার সৃষ্টি হয়েছে।’
ইমনের গড়ে তোলা খামার দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেও খামার তৈরির পরিকল্পনা করছেন নলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সংরক্ষিত সদস্য লিপি বেগম। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ইমন ভাইয়ের দেখাদেখি অন্যরা খামার দেয়ার চেষ্টা করতিছে। অনেকে দেখতে এসেও বুদ্ধি নিয়ে খামার দিচ্ছে। আমিও চিন্তে-ভাবনা করতিছি; একটা হাঁসের খামার দেব।’
এ বিষয়ে খামারি ইমরুল কাওছার ইমন বলেন, ‘করোনা মহামারিতে সব ব্যবসায় বিশাল ক্ষতির মুখে পড়ি। এরপর গ্রামে কিছু করার চিন্তা থেকেই খামারের পরিকল্পনা করি।
সম্প্রতি খামারটি পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও গাইবান্ধা-৩ আসনের সংসদ সদস্য উম্মে কুলসুম স্মৃতি। এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রজেক্টটি দেখে আমি অভিভূত। যুবকরা যে পারে, এটা তার দৃষ্টান্ত উদাহরণ।’