করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ কমে আসায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও বন্ধই আছে মাদারীপুরের অন্তত ২৭ কিন্ডারগার্টেন। দেড় বছরে আর্থিক অনটনসহ নানা কারণে বন্ধ হয়ে গেছে এসব প্রতিষ্ঠান। যারা টিকে আছে, শিক্ষার্থী ফিরবে কি না তা নিয়ে আছে সংশয়ে।
মাদারীপুর জেলা কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশন ও জেলার বেশ কিছু স্কুল ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
বন্ধ হয়ে যাওয়া কিন্ডারগার্টেনের মধ্যে একটি মাদারীপুর পৌর শহরের পাঠককান্দি এলাকার ‘কবি নজরুল শিশু বিদ্যালয়’।
পাঠককান্দি এলাকায় ২০১১ সালে দুটি ঘর ভাড়া নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় বিদ্যালয়টির। ৮ শিক্ষক ও দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর পদচারণে মুখরিত হয়ে ওঠে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ।
এখন ওই দুটি ঘরের একটি ভাড়া দেয়া হয়েছে। অন্যটি পরিত্যক্ত হিসেবে পড়ে আছে, রাখা হয়েছে বালু।
করোনা মহামারি শুরুর পর মাস দুয়েক চললেও পরে আর্থিক অনটনে আর এগােতে পারেনি স্কুলটি।
কবি নজরুল শিশু বিদ্যালয়ের সভাপতি হাজি জাহাঙ্গীর ফকির বলেন, ‘প্রতি মাসে শিক্ষকদের বেতন, বিদ্যালয়ের আনুষঙ্গিক ব্যয় আর বাসাভাড়া বাবদ প্রায় ২ লাখ টাকা খরচ হতা। সেই টাকা জোগাড় না হওয়ায় ম্যানেজিং কমিটি ও মালিকপক্ষ বিদ্যালয়টি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
‘করোনার কারণে শিক্ষার্থী আসা বন্ধ হয়ে যায়। তাও দুই মাস চালিয়েছি। পরে আর চালানো যায়নি। শিক্ষকরা অন্য জায়গায় চলে গেছে। শিক্ষার্থীরাও আর ফিরে আসেনি।’
জেলা কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশন বলছে, মাদারীপুরে করোনার আগে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা ছিল ১০৩টি। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ছিল ৫০টি, শিবচরে ২৫টি, কালকিনিতে ১৮টি ও রাজৈর উপজেলায় ১০টি।
এফ এইচ কিন্ডারগার্টেনের খেলার মাঠে এখন চাষ হচ্ছে সবজি। ছবি: নিউজবাংলা
সেগুলোর মধ্যে সদর উপজেলায় বন্ধ হয়েছে ১০টি, শিবচর উপজেলায় ১০টি, কালকিনিতে ২টি ও রাজৈরে ৫টি।
জেলা সদরে গোল্ডেন ফিউচার, প্রভাতী শিশু একাডেমি, বর্ণমালা আইডিয়াল, জেএকে চাইল্ড কেয়ার স্কুল, প্রভাতী শিশু শিক্ষা নিকেতন, স্বামী প্রবানন্দ বিদ্যানিকেতন, কবি নজরুল, সোনামণি শিশু বিদ্যালয়, সপ্তঙিঙ্গাসহ ব্রাক পরিচালিত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে গেছে।
শহরের তাজনন্নেছা কল্লোল শিশু বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকির মোহাম্মদ শাজাহান জানান, নিজস্ব ভবনে হওয়ায় তার বিদ্যালয়টি জোড়াতালি দিয়ে কোনো রকমে টিকে আছে। তবে এই বছরে তেমন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি না হওয়ায় তিনিও সংকটের মধ্যে রয়েছেন। করোনার আগে তার বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১৭৫ জন। বর্তমানে আছে ৪০ জন।
‘এ বছর ভর্তি কম হওয়ায় স্কুলের ১০ জন শিক্ষক ও ৪ জন কর্মচারীর বেতন কোথা থেকে দেব সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’
গত দেড় বছরে ছাত্র-ছাত্রীদের বেতন আদায় না হওয়ায় কর্মরত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দিতে পারেনি স্কুলগুলো।
ভাড়া বাড়িতে স্থাপিত চিলড্রেন গ্রেস স্কুলের অধ্যক্ষ মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘তাদের মাসিক বাড়িভাড়া দিতে হয় ৩০ হাজার টাকা। বাড়ির মালিক চিকিৎসক আলী আকবর করোনার সময় এক বছর বাড়িভাড়া দাবি করেননি। তবে এখন স্কুল চালু হওয়ায় বাড়ি ভাড়া নেয়ার কথা জানিয়েছেন।’
মানবিক কারণে বকেয়া বাড়িভাড়া হয়তো কিছু ছাড় দিতে পারেন। তার স্কুলেও করোনার আগে ৩০০-এর মতো ছাত্র-ছাত্রী ছিল। এ বছর তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। শিক্ষক ছিলেন ১৪ জন, এখন আছেন ১১ জন। অথচ কিন্ডারগার্টেনটিতে একসময়ে ২৭ জন শিক্ষক ছিলেন বলে জানান তিনি।
জেলা কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান রিপন জানান, মাদারীপুর শহরের চিলড্রেন গ্রেস, কল্লোল শিশু বিদ্যালয় ও এফএইচ কিন্ডারগার্টেনের অবস্থা একসময় ভালো ছিল। আরও ৫ থেকে ৬টি কিন্ডারগার্টেনের অবস্থাও মোটামুটি ভালো ছিল।
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে তাদের অবস্থাও ভালো নেই। করোনার কারণে ২৭টি কিন্ডারগার্টেনের প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থী অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলে গেছে।’
এ ব্যাপারে মাদারীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন বলেন, ‘বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেন আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আমরা তাদের শুধু পাঠ্য বইগুলো দিয়ে থাকি। তবে করোনার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঝুঁকিতে রয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এখন নেইও।’
জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন বলেন, ‘কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। এ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আমাদের কিছু করণীয় নেই। তবুও করোনার দুর্দিনের পর স্কুল পরিচালনার ব্যাপারে কোনো সহযোগিতা তারা চাইলে আমরা তা দিতে প্রস্তুত।’