রাজারবাগ দরবার শরিফের পির মো. দিল্লুর রহমানের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ তুলে উচ্চ আদালতে গেছেন ভুক্তভোগীরা। এই পিরের বিরুদ্ধে অন্যের সম্পত্তি দখলে গায়েবি মামলা দিয়ে হেনস্তা করার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
রাজারবাগ দরবার শরিফের সব সম্পদের বিষয়ে তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে তাদের কোনো জঙ্গি সম্পৃক্ততা আছে কি না, তা তদন্ত করতে বলা হয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে।
প্রশ্ন উঠেছে, রাজধানীর বুকে প্রশাসনের অগোচরে কীভাবে এত ক্ষমতাধর হয়ে উঠলেন দিল্লুর রহমান? তিন দশক ধরে মুরিদ-ভক্তদের নিয়ে সাইয়্যিদুল আ’ইয়াদ শরিফ নামের দরবার শরিফ কীভাবে এত প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে?
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রকৌশলীর সন্তান দিল্লুর রহমান বিভিন্ন ব্যক্তির সম্পত্তি দখলের জন্য ‘মামলাবাজ সিন্ডিকেট’ গড়ে তোলেন ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে। এই সিন্ডিকেটের মামলা থেকে আপন ভাইও রেহাই পাননি। পির দিল্লুরের বিরুদ্ধে ধর্মীয় উগ্রপন্থায় মদদ দেয়ার অভিযোগও পুরোনো।
যেভাবে পির হলেন দিল্লুর রহমান
মো. দিল্লুর রহমান ১৯৮৬ সালে রাজারবাগে তার পৈত্রিক বাড়িতে ‘দরবার শরিফ’ প্রতিষ্ঠা করেন। তার বাবার নাম মো. মোখলেসুর রহমান।
পারিবারিক কয়েকটি সূত্র জানায়, দিল্লুর রহমানের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। তরুণ বয়সে ইসলাম সম্পর্কে ভালো জ্ঞান, সেই সঙ্গে আরবি ও ফারসি ভাষায় দক্ষতার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি অনুসারীদের মাঝে জনপ্রিয়তা পান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে তার ভক্ত-মুরিদের সংখ্যা। একপর্যায়ে তিনি ঢাকার বুকে বড় মাপের একজন পির হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
পিরের পরিবারের এক সদস্য পরিচয় গোপন রাখার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের পরিবারে তার (দিল্লুর রহমান) আগে কোনো পির নেই। তার বাবা ছিলেন একজন প্রকৌশলী ও ব্যবসায়ী। গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজারের প্রভাকরদীতে। নয় ভাইবোনের মধ্যে দিল্লুর রহমান তৃতীয়।’
তিনি বলেন, ‘দিল্লুরের বাবা মুক্তিযুদ্ধের আগেই রাজারবাগে বাড়ি করেন। সেখানেই স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় দিল্লুর রহমান ছিলেন উচ্চ মাধ্যমিক ছাত্র। পড়তেন লক্ষ্মীবাজারের তৎকালিন কায়েদ ই আজম কলেজে (বর্তমান সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ)। পরে এই কলেজ থেকেই তিনি ডিগ্রি পাস করেন।’
পরিবারের ওই সদস্য জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় এপ্রিল মাসে পিরের বাবা সপরিবারে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। সেখানে দিল্লুরের মেজ ভাই হাফিজুর রহমান হারুন ও চাচাত ভাইয়েরা যুদ্ধে যোগ দেন। কয়েক দিন পর একটি চিরকূট লিখে দিল্লুর রহমানও বাসা ছেড়ে চলে যান। চিরকূটে তিনি যুদ্ধে যাওয়ার কথা জানান। তবে একমাস পরেই বাড়ি ফিরে আসেন দিল্লুর। এরপর থেকেই তার চলাফেরায় পরিবর্তন দেখা যায়। তিনি ধর্মকর্মে মনোনিবেশ করেন।
মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ে ঢাকায় ফিরে কলেজে যেতে শুরু করেন দিল্লুর। সেই সঙ্গে ধর্মকর্মে বাড়তে থাকে মনোযোগ। শার্ট-প্যান্ট ছেড়ে পায়জামা-পাঞ্জাবি-টুপি পড়া শুরু করেন। সাধারণ পড়ালেখার পাশাপাশি ইসলামিক বই পড়া শুরু করেন তিনি।
পারিবারিক সূত্র জানায়, ডিগ্রি পড়ার সময় যাত্রাবাড়ীর পির আবুল খায়ের ওয়াজিউল্লাহর মুরিদ হন দিল্লুর রহমান। সেই সঙ্গে আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক রোকন উদ্দীনের কাছে তিনি আরবি ও ফারসি ভাষার তালিম নেন। পরে রোকন উদ্দীনের মেয়েকেই বিয়ে করেন দিল্লুর রহমান।
পির পরিবারের কয়েক সদস্যের দাবি, ইসলামি ডিগ্রি না থাকলেও অসংখ্য ধর্মীয় বই পড়ে ও আলেমদের কাছাকাছি থেকে ব্যাপক ইসলামিক জ্ঞান অর্জন করেন দিল্লুর রহমান। এজন্য অনেক সুপরিচিত আলেমও তরুণ দিল্লুরের সঙ্গে যুক্তিতর্কে পেরে উঠতেন না। খুব অল্প সময়ে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা তৈরি হয়। আর সেই জনপ্রিয়তাকে ভিত্তি করে ১৯৮৬ সালে ঢাকার পৈত্রিক বাড়িতে দরবার শরিফ স্থাপন করে তিনি পুরোদস্তুর পির বনে যান। বাড়তে থাকে তার ভক্ত-মুরিদের সংখ্যা।
পিরের এক আত্মীয় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ইসলামজ্ঞানে তার দখলের কারণে একটা সময় পর্যন্ত তাকে নিয়ে আমরা খুব গর্ব করতাম। সম্মান দিয়ে পরিবারের সদস্যরাও তাকে হুজুর বলে সম্বোধন করত। তবে ১৯৯৮ সালে দিল্লুর রহমানের বাবা মারা যাবার পর তার কাছে ধর্মব্যবসায়ীরা ভিড়তে থাকে। তার বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে। এরপর সে তার পৈত্রিক বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে নিজের ভাইদের বিরুদ্ধেই মামলা করে। সেই থেকে শুরু হয় তার মামলাবাজ সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য।’
পির মো. দিল্লুর রহমানের গ্রামের বাড়ি
পিরের মামলায় ভাইয়েরাও জেলে
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা যায়, এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক ব্যক্তি পিরের মামলাবাজ সিন্ডিকেটের হয়রানির শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে পিরের আপন তিন ভাইও আছেন।
রাজারবাগের পৈত্রিক সম্পদ দখলের জন্য পির তার মুরিদদের দিয়ে তিন ভাই আনিসুর রহমান ফিরোজ, হাফিজুর রহমান হারুন ও জিল্লুর রহমান তরুণের বিরুদ্ধে মামলা করান। এসব মামলায় তারা জেলও খেটেছেন। এদের মধ্যে জিল্লুর রহমান তরুণের বিরুদ্ধে ৩০টি মামলা করেন পিরের মুরিদরা। অন্য ভাইয়েরা পরে আপসের মাধ্যমে দিল্লুরের রোষানল থেকে এখন মুক্ত হলেও সমঝোতা না করায় বাবার বাড়ি ছেড়ে ভাড়া বাসায় থাকতে হচ্ছে জিল্লুর রহমান তরুণকে।
তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন, মানব পাচার, মাদক, হত্যাসহ গুরুতর বিভিন্ন অভিযোগে মামলা করেন দিল্লুরে মুরিদরা। এর মধ্যে ২৩টি মামলায় তরুণ খালাস পেলেও সাতটি এখনও বিচারাধীন।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে জিল্লুর রহমান তরুণ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার আপন ভাই আমার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে, এই লজ্জার কথা আমি কাউকে বলতে চাই না। আমি আমার মতো আছি, তার (দিল্লুর রহমান) সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের বংশে কোনো পির ছিল না। আমরা এক সময় তাকে নিয়ে খুব গর্ব করতাম। কিন্তু কিছু খারাপ মুরিদ আর স্ত্রীর প্ররোচনায় সে অধঃপতনে গেছে।’
ভাস্কর্য ভাংচুর ও উগ্রবাদে জড়ানোর অভিযোগ
রাজারবাগ পির দিল্লুর রহমানের প্রতিষ্ঠা করা ধর্মীয় সংগঠন আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত। ২০০০ সাল থেকে এই সংগঠনের বিরুদ্ধে উগ্রবাদি তৎপরতার অভিযোগ রয়েছে।
জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০০৯ সালে ১২টি ধর্মভিত্তিক সংগঠনকে কালো তালিকাভুক্ত করে সরকার। এগুলোর মধ্যে অন্যতম আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত। এছাড়া, পির দিল্লুর রহমানের নিজস্ব পত্রিকা দৈনিক আল ইহসান ও মাসিক পত্রিকা আল বাইয়্যিনাতে গণতন্ত্র, নির্বাচন, জাতীয় সংগীত, বৈশাখী উৎসব, খেলাধুলা ইত্যাদি বিষয়ে নেতিবাচক মতামত প্রকাশের অভিযোগ রয়েছে।
২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর আল বাইয়্যিনাতের অনুসারীরা মতিঝিলের বলাকা ভাস্কর্য ভাংচুর করেন। এ ঘটনায় পুলিশ আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাতের আট সশস্ত্র কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছিল। তারা জিজ্ঞাসাবাদে জানান, ভাস্কর্য ভাঙার নির্দেশ দিয়েছিলেন দিল্লুর রহমান।
ওই ঘটনার কয়েক মাস পর আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাতের অনুসারীরা বিমানবন্দর গোলচত্বরে বাউলের ভাস্কর্যটিও ভেঙে ফেলেন। এছাড়া, ২০১৭ সালে হাইকোর্ট চত্বরে লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্য স্থাপনের পরপরই আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত সেটি সরিয়ে ফেলতে উড়ো চিঠিতে হুমকি দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
পিরের পরিবারের এক সদস্য নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এসব ঘটনার পরিকল্পনা পিরের দরবার শরিফে বসেই হতো। মতিঝিলের বক (বলাকা ভাস্কর্য) ভাঙার মিটিংয়ের আলোচনার কিছুটা আমি নিজ কানে শুনেছিলাম। তার এসব অপকর্মের জন্য অন্য ভাইদেরও পুলিশ-গোয়েন্দাদের চাপে পড়তে হয়েছে। তবে তার ভাইয়েরা জড়িত ছিল না। এরপর বাধ্য হয়ে পিরের তিন ভাই মিলে সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, ঘটনার সব দায় আল বাইয়্যিনাতের।’
গ্রামের বাড়িতে যান না দিল্লুর রহমান
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার প্রভাকরদী গ্রামের মৃত মোখলেসুর রহমানের ছেলে দিল্লুর রহমান। এক সময়ের গ্রাম্য মাতবর মোখলেসুর রহমানকে গ্রামের সবাই এক নামে এখনও চেনেন। তবে তার ছেলে দিল্লুর রহমান সম্পর্কে তারা খুব একটা তথ্য দিতে পারেননি।
প্রভাকরদী গ্রামে দিল্লুরদের পৈত্রিক বাড়ির নাম ‘মিয়া বাড়ি’। সেখানে ‘মিয়া মসজিদ’ নামে একটি মসজিদও রয়েছে। ভিটায় রয়েছে তিন তলা একটি ভবন, তবে সেখানে কেউ থাকেন না।
গ্রামের বাড়িতে পির মো. দিল্লুর রহমানের কথিত মাদ্রাসা
গ্রামবাসী জানান, দিল্লুর রহমান গ্রামে না গেলেও তার অনুসারীরা সেখানে যাতায়াত করেন। প্রতিবেশী এক নারী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই বাড়িতে কেউ থাকে না। হুজুর (দিল্লুর রহমান) এখানে আসে না, কিন্তু তার লোকজন আসে। তারা এসে কয়েক ঘণ্টা থেকে আবার চলে যায়। মাঝে মধ্যে তার বড় ভাই আসত, তবে তিনিও এখন আসেন না। তাই বাড়িটা ফাঁকাই থাকে।’
গ্রামের বাসিন্দারা জানান, কয়েক দশক আগে তারা হঠাৎ শুনতে পান, মোখলেস মাতবরের ছেলে দিল্লুর পির হয়ে গেছেন। এরপর সাদা কাপড় পরে বিশাল ভক্তদল নিয়ে তিনি প্রতি বছর একবার গ্রামে মাহফিল করতে আসতেন। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে সেই মাহফিলও বন্ধ।
পিরের অনুসারীদের কয়েক জন দাবি করেন, প্রভাকরদী গ্রামের পাশে সরাবদী গ্রামে দিল্লুর রহমানের একটি মাদ্রাসা আছে। তবে সেই ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে একটি টিনশেড ঘর দেখা গেছে।
ঘরের বাইরে মাটি কাটছিলেন একজন। নিজেকে মাদ্রাসার শিক্ষক পরিচয় দিয়ে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার জন্য মাদ্রাসা বন্ধ। এখানে বাংলা ও আরবি পড়ানো হয়। এটি পীর সাহেবের তৈরি কামিল মাদ্রাসা।’
মাদ্রাসায় কত জন শিক্ষার্থী শিক্ষক রয়েছে, এমন প্রশ্নের কোনো জবাব তিনি দিতে পারেননি।
গ্রামবাসীর দাবি, টিনশেড ঘরটি কোনো মাদ্রাসা নয়। আগে সেখানে এক ব্যক্তি পরিবার নিয়ে থাকতেন। তিনি চলে যাওয়ার পর এখন আরেকটি পরিবার আছে।
সরাবদী গ্রামে দিল্লুর রহমানের জমি দখলের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মামলার ভয়ে এ বিষয়ে মুখ খুলতে চান না কেউ। গ্রামের এক জন জানান, ‘বিভিন্ন মানুষের খেতে খুঁটি গেঁথে রেখেছেন পিরের অনুসারীরা। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। এক মামলা শেষ না হতেই আরেক মামলার মুখে পড়তে হয়।