বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

দূরের বস্তু দেখার ক্ষমতা হারাচ্ছে শিশুরা

  •    
  • ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১০:২৭

করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকায় বাচ্চাদের হাতে উঠেছে মোবাইল কিংবা ল্যাপটপ, নোটবুক। যারা আগে এসব ডিভাইস থেকে দূরে ছিল তারাও হয়েছে আসক্ত। খেলার সময়, খাওয়ার আগে, অনলাইন ক্লাস, ঘুমের সময় ক্ষণে ক্ষণে চাই মোবাইল। আর এতে করে শিশুদের মাঝে ‘মায়োপিয়া’ বা চোখের ক্ষীণ দৃষ্টিজনিত রোগ বাড়ছে।

রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থী আরিশা। বয়স ১১ বছর। চোখের ক্ষীণ দৃষ্টিজনিত রোগের কারণে চিকিৎসকের পরামর্শে গেল তিন বছর ধরে চশমা ব্যবহার করছেন। ছয় মাস পর পর চশমার পাওয়ার পরিবর্তন করা লাগে। সবশেষ জুনে চশমার পাওয়ার পরিবর্তন করা হয়েছে।

আরিশার মা ফামিদা তারিন জানান, এটা জন্মগত কোনো সমস্যা নয়। পড়াশোনা ও অধিক সময় মোবাইল ব্যবহারের কারণে কমে এসেছে দূরের দৃষ্টি শক্তি। করোনার কারণে মোবাইল নির্ভরতা আরও অনেক বেড়েছে। করোনার মধ্যে রুটিনের বাইরে চলে গেছে মোবাইল ব্যবহারের পরিমাণ।

ফামিদা বলেন, ‘মাঝে মাঝে মাথা ব্যথা ও চোখ ব্যথায় ভোগে আরিশা। এখন রাতে ঘুমায় দেরি করে, সকালে ওঠে দেরি করে। উঠেই মোবাইল খোঁজে। কিছু বললে বলে মোবাইলে পড়ালেখা করবে। আর আমরা সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকায় মনিটরিংও করতে পারছি না।’

আরিশার মতো হাজার শিশু এখন এই সমস্যায় ভুগছে।

করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকায় বাচ্চাদের হাতে উঠেছে মোবাইল কিংবা ল্যাপটপ, নোটবুক। যারা আগে এসব ডিভাইস থেকে দূরে ছিল তারাও হয়েছে আসক্ত। খেলার সময়, খাওয়ার আগে, অনলাইন ক্লাস, ঘুমের সময় ক্ষণে ক্ষণে চাই মোবাইল। আর এতে করে শিশুদের মাঝে ‘মায়োপিয়া’ বা চোখের ক্ষীণ দৃষ্টিজনিত রোগ বাড়ছে।

করোনার সময়ে মাইওপিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

কী পরিমাণ এমন রোগী রয়েছে তার পরিসংখ্যান না থাকলেও দেশের সবচেয়ে বড় জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগের পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক। গেল দুই বছরে এই হাসপাতাল থেকে সেবা নেওয়া মায়োপিয়া রোগী বেড়েছে ১১ শতাংশ।

হাসপাতালের পরিসংখ্যান বলছে, করোনার আগে এই হাসপাতালে সেবা নেয়া রোগীর ২২ শতাংশ মাইয়োপিয়া আক্রান্ত রোগী পাওয়া যেতে। করোনা কারণে ঘরবন্দি থাকায় শিশুদের মধ্যে বেড়েছে এ রোগ। এখন বেড়ে ৩৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, প্রায় দুই বছর শিশুরা ঘরবন্দি। কাজ না থাকায় সারাক্ষণ স্ক্রিনে; দূরের জিনিস দেখেনি। ফলে তাদের দূরের দৃষ্টিশক্তি ঠিকমতো তৈরিই হচ্ছে না। আটবছর পর্যন্ত শিশুদের চোখের গঠনগত পরিবর্তন হতে থাকে। এই বয়সের শিশুরা যদি দূরের জিনিস না দেখে তাহলে আস্তে আস্তে দূরের দৃষ্টিশক্তিই হারিয়ে ফেলবে। বড় হওয়ার পরেও তাদের এই সমস্যা কাটবে না।

এ বিষয়ে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিউটের অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী জানান, করোনার কারণে মায়োপিয়া রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। সরকারের দেয়া বিধিনিষেধ স্বাভাবিক হওয়ার পর হাসপাতালে রোগী অনেকগুণ বেড়েছে।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘লকডাউনের মধ্যে আমাদের হাসপাতালে দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ জন রোগী দেখলেও এখন এই সংখ্যা বেড়ে ৩০০ খেকে ৪০০ হয়েছে। এদের মধ্যে ৩৩ শতাংশই দূরে দেখার দৃষ্টিতে সমস্যা নিয়ে আসে। তার একটি বড় অংশ শিশুরা।’

খায়ের আহমেদ জানান, করোনার আগে ২০১৯ সাল ও ২০২০ সালে ২০ থেকে ২২ শতাংশ ছিল মায়োপিয়া। করোনার মধ্যে এ জাতীয় রোগীর হার বেড়েছে ১১ শতাংশ। এর অন্যতম কারণ করোনা মধ্যে শিশুদের ডিভাইসে আশক্তি।

শিশুরা এখন অধিকাংশ সময় এখন অনলাইনে কাটায়। করোনা সংক্রমণের আগে বাচ্চারা বাবা-মায়ের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানের ঘুরতে যেতে পারত, এখন সেটাও করতে পারেনা। ঘরবন্দি বাচ্চারা সময় কাঁটতে মোবাইলকে বেছে নিচ্ছে। ঘুমের সময় ছাড়া বাকি সময় কাটছে মোবাইলের মাধ্যমে।

করণীয় কী

করোনার কারণে এতদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হচ্ছে। শিশুদেরকে মোবাইল, ল্যাপটপ জাতীয় ডিভাইস থেকে ফেরাতে তাদের হাতে তুলে দেয়া যেতে পারে গল্পের বই। সেই সঙ্গে শিশুদের সঙ্গে বাবা-মায়েরা গল্প করতে পারে। পরিবারের সবাই মিলে মিলে মাঝে মাঝে আড্ডার ব্যবস্থা করতে পারে।

সবাই মিলে চেষ্টা করলে এই সমস্যা কাটিয়ে তোলা যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের পরামর্শ, শিক্ষকরা অনলাইনে ক্লাস নিলে যেন বিরতি নেয়। ৩০ মিনিট পর পর গ্যাপ দিলে বেশি ভালো হয়।

এ সমস্যা কাটাতে আরও কিছু পরামর্শ দিয়েছেন শিশু বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কথা বলেছেন তারা। শাক-সবজি বেশি করে খেতে হবে। শহর এলাকার বাচ্চাদের বেশির ভাগ ফাস্ট ফুডের ওপর নির্ভরশীল। এই খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে।

ডিভাইসগুলো অবশ্যই সীমিত পরিসরে ব্যবহার করতে হবে। অল্প আলোতে লেখাপড়া যাতে না করে সেটাও লক্ষ্যে রাখতে হবে। বাড়ির কাজ করলে বিরতি দিয়ে দিয়ে করতে হবে। গল্পের বই একটানা যেন দীর্ঘ সময় ধরে না পড়ে। এক্ষেত্রে শুধু অভিভাবকরা নয়, চিকিৎসক ও শিক্ষকদেরও ভূমিকা রাখতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিজ্ঞানের বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাজনীন খান নিউজবাংলাকে বলেন, চোখের ক্ষীণ দৃষ্টিজনিত সমস্যা দূর করতে কোনোভাবে যেন একনাগাড়ে কম্পিউটারের সামনে বা কোনো ডিভাইসের সামনে না থাকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

তার ভাষ্য, শিশুদের চোখের সমস্যা স্থায়ী হয়ে যাওয়ার কারণ সঠিক সময়ে তাদের চোখ বা দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা করা হয় না। শিশুদের দৃষ্টিশক্তি কম থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে যতক্ষণ তারা কথা না বলে বোঝাতে পারছে ততক্ষণ তাদের অভিভাবকরা বুঝতেই পারেন না তার শিশুর চোখের দৃষ্টিশক্তি কত।

দেশের বাইরেও পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক

করোনাভাইরাস মহামারিতে ঘরে আটকে থাকা শিশুদের দৃষ্টিশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য বেরিয়ে এসেছে চীন ও হংকংয়ে পরিচালিত কয়েকটি গবেষণাতেও।

আরও পড়ুন: ঘরবন্দি শিশুদের দূরের বস্তু দেখার ক্ষমতা কমছে

হংকংয়ের দ্য চায়নিজ ইউনিভার্সিটি অফ হংকং-এর একদল গবেষক দেড় বছরের বেশি সময় গবেষণা চালানোর পর বলছেন, দূরের বস্তু পরিষ্কার দেখতে পাওয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছে অনেক শিশু। তাদের নিবন্ধটি ব্রিটিশ জার্নাল অফ অফথমলজিতে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষকরা গত বছর ৬ থেকে ৮ বছর বয়সী ৭০৯ শিশুকে পর্যবেক্ষণ করে অনেকের মধ্যেই হ্রস্বদৃষ্টি বা মায়োপিয়ার লক্ষণ দেখতে পান। এ ধরনের শিশুরা কাছের বস্তুকে ভালোভাবে দেখতে পেলেও দূরের বস্তু ছিল ঘোলাটে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের তুলনায় করোনার প্রথম বছরে শিশুদের মায়োপিয়ায় আক্রান্তের হার বেড়েছে ১০ শতাংশ।

গবেষকরা বলছেন, মহামারির সময়ে শিশুদের জীবনযাপনে পরিবর্তন আসায় মায়োপিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। তারা বাড়ির বাইরে যেতে পারছে না। পাশাপাশি দিনভর ঘরের ভেতরে ডিজিটাল মাধ্যমে আসক্তি, আঁকাআঁকি, বই পড়ার মতো কাজ করায় ‘হ্রস্বদৃষ্টি’ তৈরি হচ্ছে।

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, মায়োপিয়ার ক্ষেত্রে জিনগত কারণের চেয়ে বেশি দায়ী ঘরের বাইরে না যাওয়া। ঘরের মধ্যে দীর্ঘদিন আটকে থাকলে মানুষের চোখ দূরের বস্তুকে দেখার জন্য প্রয়োজনীয় অভিযোজন ক্ষমতা হারাতে থাকে।

হংকংয়ের গবেষকরা তাদের নিবন্ধে লিখেছেন, ‘মহামারির বিস্তার ঠেকাতে ঘরে থাকার বাধ্যবাধকতা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার মতো ব্যবস্থা চিরদিন থাকবে না, তবে এই সময়ে ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্তিসহ মানুষের জীবনযাপনে যে পরিবর্তন ঘটছে, তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সবার জীবনে, বিশেষ করে শিশুদের ওপর থাকবে।’

আধুনিক জীবনে বিভিন্ন দেশেই মায়োপিয়া উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীনের ৯০ শতাংশের মতো মানুষ হ্রস্বদৃষ্টির সমস্যায় আক্রান্ত, এ কারণে দেশটিতে মায়োপিয়াকে মহামারি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, চীনে ২০২০ সালে ৬ বছর বয়সী শিশুদের মায়োপিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে তিন গুণ বেড়েছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রকাশিত ওই গবেষণায় চীনে মায়োপিয়া বাড়ার কারণ হিসেবেও লকডাউনকে দায়ী করা হয়েছে।

আক্রান্তের লক্ষণ কী কী

ঘরে থাকা শিশু বারবার মোবাইল বা টেলিভিশন দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, বারবার চোখের পাতা বন্ধ করে খুলতে থাকলে মাওপিয়া আক্রান্ত হতে পারে। মাঝে মাঝে মাথা ও চোখব্যথা হতে পারে।

অনেক সময় দৃষ্টিত্রুটির কারণে চোখ বাঁকা হতে পারে। আবার চোখ বাঁকা হওয়ার কারণে দৃষ্টিতে ত্রুটি হতে পারে। কিছু পড়তে গেলে শিশু চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করছে কি না, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে।

লক্ষণগুলো দেখা দিলে অভিভাবকদের উচিত দ্রুত সময়ের মধ্যে শিশুকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া।

জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘এখন আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে। আক্রান্ত শিশুরা যখন স্কুলে গিয়ে ক্লাস করবে, তাদের ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা দেখতে অসুবিধা হবে।

‘তারা (আক্রান্ত শিশু) ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা খাতাতে তুলতে পারে না। এ কারণে পাশের বাচ্চা থেকে লেখা কপি করে।’

চিকিৎসা কী

এ রোগের প্রধান কারণ মোবাইল ফোন অথবা অন্য কোনো ডিভাইসের প্রতি নির্ভরতা। কম্পিউটার বা মোবাইল থেকে এক ধরনের নীল আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে। নিয়মিত দীর্ঘসময় ধরে নীল উজ্জ্বল আলো চোখের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, যা দীর্ঘমেয়াদে অঙ্গটির ক্ষতি করে। করোনাভাইরাসের কারণে এ সমস্যা বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ রোগ থেকে বাঁচতে অভিভাবকদের সচেতনতা সবচেয়ে জরুরি।

জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা যারা চক্ষু বিশেষজ্ঞ, তাদের যেমন ভূমিকা রয়েছে, একই সঙ্গে এখানে অন্য চিকিৎসক ও অভিভাবকদের তেমন ভূমিকা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে শিশু চিকিৎসকরা। শিশুদের কোনো সমস্যা দেখা দিলে অভিভাবকরা দ্রুত তাদের কাছে নিয়ে আসেন। তারা অন্যান্য পরীক্ষার সঙ্গে চোখের পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিতে পারেন।

‘এসব সমস্যা দেখা দিলে হয়তো চশমা দিয়ে সমাধান করা যাবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সচেতনতায় এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।’

এ বিভাগের আরো খবর