পাবনার ফরিদপুর অঞ্চলে দুধ উৎপাদন খামারিরা লোকসানের অজুহাতে মিল্ক ভিটা কারখানায় দুধের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। এতে মিল্ক ভিটার উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে।
অবৈধভাবে দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র স্থাপন করে তারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দুধ শীতলীকরণ করছে। অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে দুধ সরবরাহ বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
দুগ্ধশিল্পের প্রসারে ১৯৭৩ সালে বড়াল নদের তীরে বাঘাবাড়ীতে গড়ে তোলা হয় সমবায়ভিত্তিক দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটা। সরকারি এ প্রতিষ্ঠান ঘিরে পাবনা-সিরাজগঞ্জ এলাকায় দুগ্ধশিল্পের যাত্রা শুরু হয়।
প্রাণিসম্পদ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, শুধু মিল্ক ভিটাকে কেন্দ্র করে পাবনা-সিরাজগঞ্জ এলাকায় ২৫ হাজার দুগ্ধ খামার গড়ে উঠেছে, যেখানে প্রতিদিন দুধের উৎপাদন গড়ে ১০ থেকে ১২ লাখ লিটার। মিল্ক ভিটা ছাড়াও আরও ১৫টি অনুমোদিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ অঞ্চলের খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে।
মিল্ক ভিটার তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৩ হাজার ৪৭৪টি প্রাথমিক দুগ্ধ সমিতি মিল্ক ভিটার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ রয়েছে। এসব সমিতির সদস্য প্রায় দেড় লাখ দুগ্ধ খামারি, যাদের কাছ থেকে প্রতিদিন ৭ থেকে সাড়ে ৭ লাখ লিটার দুধ উৎপাদিত হয়।
সম্প্রতি তালিকাভুক্ত খামারিরা লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে মিল্ক ভিটায় দুধের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। এতে মিল্ক ভিটার উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে।
মিল্ক ভিটা জোনের আওতাভুক্ত পাবনার ফরিদপুর উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম আরকান্দি। গত কয়েক দশকে এ গ্রামে দুধের উৎপাদন বেড়েছে ব্যাপকভাবে। মিল্ক ভিটার মাধ্যমে গ্রামটিতে দুগ্ধশিল্প গড়ে উঠলেও এখন মিল্ক ভিটা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন এখানকার খামারিরা।
উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পাওয়া এবং সময়মতো বোনাসের টাকা না পাওয়ার অভিযোগ তাদের।
মিল্ক ভিটায় চুক্তিবদ্ধ কিছু সমিতি বেছে নিয়েছে অসাধু পন্থা। অনুমতি ছাড়া মিল্ক ভিটা জোনে দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে তারা। খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে তা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের দুগ্ধ ও মিষ্টির কারখানায় বিক্রি করছে এই শীতলকরণ কেন্দ্রগুলো।
বাজারজাতকরণ নীতিমালা অগ্রাহ্য করে স্বাস্থ্যবিধি মানা ছাড়াই ইচ্ছামতো দুধ বাজারজাত করছে খামারি ও দুগ্ধ সমবায় সমিতি।
সরেজমিনে আরকান্দি বাজার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ব্যক্তি উদ্যোগে এ গ্রামে মিল্ক ভিটায় চুক্তিবদ্ধ সমিতির সহায়তায় গড়ে উঠেছে পাঁচটি দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র।
গ্রামের প্রাথমিক দুগ্ধ সমিতিগুলোর একটির সভাপতি মোহর আলী জানান, তাদের সমিতিতে প্রায় ৬৭টি গরু থেকে প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৩০ লিটার দুধ হয়। কয়েক মাস আগেও পুরো দুধ মিল্ক ভিটায় সরবরাহ করা হতো। কিন্তু উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় তারা এখন নিয়মিতভাবে মিল্ক ভিটায় দুধ সরবরাহ করছেন না।
মোহর আলী জানান, মিল্ক ভিটায় দুধের ফ্যাট দেখে দাম নির্ধারণ করা হয়। ফলে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা লিটারের বেশি দাম তারা পান না। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ব্যক্তিগত শীতলীকরণ কেন্দ্রে দুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে লিটারপ্রতি কমপক্ষে ৪৫/৫০ টাকা পাওয়া যাচ্ছে।
আরকান্দি প্রামাণিকপাড়া প্রাথমিক দুগ্ধ সমিতির সভাপতি আব্দুল মমিন নিজেই গড়ে তুলেছেন এ রকম একটি দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র। মিল্ক ভিটার সমিতির সদস্যদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে তার কারখানায় শীতলীকরণ করে রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বেশি দামে বিক্রি করছেন তিনি।
আব্দুল মমিন বলেন, প্রতিদিন ৫০০ থেকে ১ হাজার লিটার দুধ খামারিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে শীতলীকরণ করে পানির ট্যাঙ্কে ভরে ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করছেন তিনি। প্রায় দুই মাস ধরে এটি করলেও কেউ তাকে বাধা দেয়নি।
বাঘাবাড়ি জোনে এ রকম ১০ থেকে ১২টি ব্যক্তিমালিকানার শীতলীকরণ কেন্দ্র আছে বলেও জানান তিনি।
চুক্তিবদ্ধ খামারিরা চাহিদামতো দুধ সরবরাহ না করায় মিল্ক ভিটায় দুধের সরবরাহ কমে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে।
মিল্ক ভিটার অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (উৎপাদন) ড. খোন্দকার মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, কয়েক মাস আগেও মিল্ক ভিটা প্রতিদিন ১ লাখ ৮০ হাজার লিটার থেকে ২ লাখ লিটার দুধ প্রক্রিয়াজাত করত। এখন মাত্র ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ লিটারের বেশি দুধ উৎপাদন করতে পারছে না।
মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপক (সমিতি) মো. রেজাউল করিম বলেন, বাঘাবাড়ি জোনের (পাবনা ও সিরাজগঞ্জ) আওতায় রয়েছে ৭ শতাধিক প্রাথমিক দুগ্ধ সমিতি, যার মধ্যে মাত্র ৩০০ থেকে ৩৫০টি সমিতি এখন মিল্ক ভিটায় দুধ সরবরাহ করছে। জুন মাস পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ লিটার করে দুধের সরবরাহ পাওয়া গেলেও এখন তা নেমে এসেছে ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার লিটারে।
মিল্কভিটা বাঘাবাড়ী জোনের ব্যবস্থাপক বাবুল আক্তার জানান, চুক্তিবদ্ধ সমিতির সদস্যরা মিল্ক ভিটা থেকে গো-খাদ্যের জন্য ঘাসের জমির সুবিধা, গবাদিপশুর চিকিৎসাসুবিধা, সহজ শর্তে ঋণের সুবিধা নিয়েও চাহিদামতো দুধ সরবরাহ না করে বাইরে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে বাঘাবাড়িতে মিল্ক ভিটার উৎপাদন কমে গেছে।
মিল্ক ভিটার চেয়ারম্যান নাদির হোসেন লিপু বলেন, গুণগত মান ভালো না হলে মিল্ক ভিটা সে দুধ গ্রহণ করে না। মিল্ক ভিটায় দুধ সরবরাহ করতে হলে কমপক্ষে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ ফ্যাট থাকতে হবে। ল্যাকটোমিটারে পরীক্ষার পর দুধের মান যাচাই করে তা সংগ্রহ করা হয়। অনুমোদনহীন কারখানায় দুধ সরবরাহ করতে মান যাচাইয়ের মুখে পড়তে হয় না বলেই খামারিরা বেশি লাভের আশায় মিল্ক ভিটার পরিবর্তে ব্যক্তি উদ্যোগে বাজারজাত করছেন।
তিনি আরও বলেন, খামারিদের স্বার্থে মিল্ক ভিটা এক বছরে দুই দফায় প্রায় ৪ টাকা লিটারপ্রতি দুধের দাম বৃদ্ধি করেছে। তবে, বাজারে এখন দুধের আরও চড়া দাম থাকায় অনেকে ব্যক্তিগতভাবে দুধ বাজারজাত করছেন। অবৈধ দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্রে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দুধ বাজারজাত করা হলেও সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায় এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। তিনি এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আল মামুন হোসেন বলেন, অনুমোদন ছাড়া যেখানে-সেখানে দুধ শীতলীকরণ কেন্দ্র বা কারখানা করা যায় না। দুধ সংগ্রহ ও বাজারজাত করতে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। প্রাণিসম্পদ বিভাগের কাছে অবৈধ কারখানার কোনো তথ্য নেই। খোঁজ নিয়ে এ ব্যাপারে নজরদারি বাড়ানো হবে। পাশাপাশি মিল্ক ভিটাকেও এগিয়ে আসতে হবে বলে জানান তিনি।