বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিকাশ প্রতারকদের নিত্যনতুন ফাঁদ

  •    
  • ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ২৩:১৮

নিত্যনতুন ফন্দি বের করে বিকাশের গ্রাহকদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলছেন প্রতারকরা। পুলিশের বিশেষ দল এদের নানা সময় গ্রেপ্তার করছে। কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না তৎপরতা। পুলিশ বলছে, একেক জন ভুক্তভোগীর অল্প পরিমাণ অর্থ খোয়া যায় বলে অধিকাংশ সময় অভিযোগই দায়ের হয় না। 

গোপালগঞ্জের রামদিয়া সরকারি শ্রীকৃষ্ণ কলেজ। এই কলেজের সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষক প্রভাষক কদর আলী। কদর আলীর নাম ব্যবহার করে এক দল প্রতারক এই কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের ফোন দিয়ে বলছে, ‘আমি তোমাদের কদর আলী স্যার। তোমাদের উপবৃত্তির ৮ হাজার ২০০ টাকা পাঠাতে হবে। একটা বিকাশ নম্বর দাও।’

এভাবে প্রতারকরা ওই কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার টাকা।

এ রকম কয়েকটি অডিও রেকর্ড এসেছে নিউজবাংলার হাতে।

কয়েকজন ভুক্তভোগি শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার। তাদের একজন পলাশ মিয়া।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমাকে ফোন দিয়ে বলা হলো, কদর আলী স্যার বলছি। একটা বিকাশ নম্বর দাও, উপবৃত্তির ৮ হাজার ২০০ টাকা যাবে। তখন আমি ফোনটা আমার ভাইয়ের কাছে দেই। আমার ভাই আমার কথায় বিশ্বাস করে স্যার ভেবে তার সঙ্গে কথা বলে তার কথা মতো কাজ করে। ফলে আমার ভাইয়ের বিকাশ অ্যাকাউন্ট থেকে ২৪০০ টাকা নিয়ে নেয় প্রতারক। আমার মতো অনেকের সঙ্গে এই কাজ করেছে বিকাশ প্রতারক।’

এ বিষয়ে কথা হয় সরকারি রামদিয়া সরকারি শ্রীকৃষ্ণ কলেজের শিক্ষক কদর আলী সঙ্গে। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের কলেজে কয়েকজন ছাত্র এসে অভিযোগ করেছে এই প্রতারণার বিষয়ে। কয়েকটি নম্বরও দিয়েছে তারা আমাদের। পরবর্তীতে আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের ফোন দিয়ে প্রতরণার বিষয়ে সাবধান করে দিয়েছি।’

বিকাশ-কেন্দ্রিক প্রতারকদের নতুন নতুন ফাঁদ

বিকাশ-কেন্দ্রিক প্রতারকদের নানান ফাঁদের বিষয়ে কথা হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তা ধরের সঙ্গে। নিউজবাংলাকে তিনি জানান, পুরনো কিছু কৌশলের পাশাপাশি নতুন নতুন উদ্ভাবনী কৌশল অবলম্বন করছেন প্রতারকেরা।

ভুল নম্বরে ভুল করে টাকা পাঠানোর কথা বলে সেটা ফেরত চাওয়া বা ওটিপি নম্বর নেওয়ার ফাঁদ পুরনো।

মুক্তা ধর বলেন, ‘নতুন কৌশলের মধ্যে দেখা গেছে, টিকা নিবন্ধনের এসএমএস পাঠিয়ে প্রতারণা করা। এক্ষেত্রে প্রতারক বলে, “আমি টিকার নিবন্ধন করেছি। তবে ভুলক্রমে আপনার নম্বরে চলে গেছে। যদি কোডটা একটু কষ্ট করে দেন, না হলে আমার আবার রেজিস্ট্রেশন করা লাগবে। না হলে আমার দেরি হয়ে যাবে।” তখন ভিকটিম মানবিক দিক বিবেচনা করে কোডটা দিয়ে দেয়। তারা মানসিকভাবে দুর্বল করে প্রতারণা করছে।’

বিকাশের প্রতারণা নিয়ে কাজ করেন সিআইডির অরগানাইজড ক্রাইম সেলের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার কামরুল আহসান। গত নয় মাসে ঢাকা থেকে টিম পাঠিয়ে ফরিদপুরে অভিযান চালিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ জনের মতো বিকাশ প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছেন তারা।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ফেসবুকে একটা পেজে দেখলাম লেখা, উপবৃত্তির টাকার জন্য এই নম্বরে যোগাযোগ করুন। আমি তখন লোকেশনটা চেক করে দেখলার ভাঙ্গা, ফরিদপুর। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিকাশ এজেন্টকেও ফোন দেয় প্রতারকরা। ফোন দিয়ে বলে, “আপনি তো দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ কমিশন পান। আমাদের অফিস থেকে কমিশন দ্বিগুণ করে পাঁচ শতাংশ করা হয়েছে। এটা অ্যাক্টিভেট করার জন্যে আমরা যা বলি তাই করেন।” প্রতারকদের কথামতো কাজ করলে টাকা অন্য নম্বরে ট্র্যান্সফার হয়ে যায়। প্রতারক টাকা নিয়ে একাধিক নম্বরে ট্র্যান্সফার করে দেয়। পরে একটা জায়গা থেকে ক্যাশ আউট করে নেয়।

‘এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির নামে বিভিন্ন অফারের কথা বলে প্রতারক। ১৬২৪৭ বিকাশের হটলাইন। এই নম্বরের সামনে অনেক সময় +৮৮ যুক্ত করে প্রতারক ফোন দিয়ে নানা ধরনের প্রলোভন দেখায়। এই বিকাশ কেন্দ্রিক চক্রের ৯০ শতাংশ ফরিদপুরের। বাকিরা মাদারিপুর ও মাগুরার।’

গ্রাহকের তথ্য প্রতারক জানে কীভাবে?

সিআইডির অরগানাইজড ক্রাইমের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার কামরুল আহসান বলেন, এজেন্টের দোকান একটা খাতা ব্যবহার করে, যে খাতায় বিকাশের ট্রানজ্যাকশনের বিকাশ নম্বর লেখা হয়। অনেক সময় প্রতারক বিকাশের টাকা তোলা বা পাঠানোর নামে গিয়ে গোপনে ওই খাতার ছবি তুলে আনে। অনেক সময় এই প্রতারনায় বিকাশের এজেন্ট ও বিকাশ কর্মকর্তারাও জড়িত থাকে।’

এ ছাড়া অনেক সংস্থা ভোক্তার ডাটা সংগ্রহ করে বলেও জানান কামরুল আহসান। তারা থার্ড পার্টির কাছে ডাটা বিক্রি করে। এ ধরনের সংস্থার কাছ থেকেও প্রতারক ডাটা সংগ্রহ করে থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন লোভ দেখিয়েও প্রতারক নিশ্চিত হন, গ্রাহকের নম্বরে বিকাশ অ্যাকাউন্ট খোলা।

বিকাশের গ্রাহকের তথ্যের বিষয়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তা ধর বলেন, ‘করোনার কারণে আমাদের সকল কার্যক্রম অনলাইনভিত্তিক হয়েছে। যে শিক্ষার্থীরা ভিকটিম হয়েছে, তারা যাচাই-বাছাই না করে তথ্য দিয়ে দিয়েছে। সে তার অসাবধানতার কারণে ভিকটিমে পরিণত হয়েছে। এখানে সচেতনতা জরুরি।’

প্রতারক মোবাইল সিম সংগ্রহ করে কোথা থেকে?

অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার কামরুল আহসান বলেন, ‘আমরা যে সকল প্রতারক গ্রেপ্তার করেছি, তাদের তথ্যমতে, একদল অসাধু সিম বিক্রেতা রয়েছে, যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে সাধারণ মানুষকে ফ্রি সিমের সঙ্গে কিছু টাকা দেবে বলে সিম গ্রাহকের আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করে। এ ছাড়া তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর সংগ্রহ করে এবং এই আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে একাধিক সিম রেজিস্ট্রেশন করে। এই চক্রগুলোর কাছ থেকে সাধারণ দামের থেকে কয়েক গুণ বেশি দামে সিম কেনে প্রতারকরা। এ কারণে প্রতারকের পরিচয় পাওয়া যায় না।’

বিকাশ প্রতারক কেন নির্মূল সম্ভব নয়!

সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার কামরুল আহসান বলেন, ‘সিআইডির যে ট্রেসিং পদ্ধতি সেটা দিয়ে এরিয়া ট্রেসিং করা যায়। যেমন, প্রতারক কোন এলাকায় আছে বা কোন টাওয়ারের আওতায় আছে। এছাড়া পিনপয়েন্ট করে প্রতারকের স্থান নির্ণয় করা সম্ভব। তবে পিনপয়েন্ট করার যে ব্যবস্থা আছে, সেটা খুব ব্যয়বহুল। রাষ্ট্রীয় অপরাধ ছাড়া পিনপয়েন্ট ট্রেসিং ব্যবহার হয় না, তাই প্রতারক গ্রেপ্তার করতে ঝামেলায় পড়তে হয়।

‘অনেক সময় ঢাকা থেকে টিম পাঠিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রতারকরা অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলে। ফরিদপুরে আমাদের দল থাকলেও এই কাজের জন্য বিশেষজ্ঞ দলের প্রয়োজন। আর এই বিশেষজ্ঞ দল ঢাকায় আছে শুধু।’

প্রতারণার শিকার হয়েও মামলা বা অভিযোগে অনীহা

বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তা ধর বলেন, ‘প্রতারকরা গ্রাহকদের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার পর্যন্ত হাতিয়ে নেয়। সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ পেয়েছি। ভিকটিম হয়তো মনে করেন, মাত্র তো ২ হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু প্রতারণা করে দিনে ২-৩ লাখ টাকাও হাতিয়ে নেয় প্রতারক।

‘ভিকটিম আমাদের জানালে আমরা বিকাশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাদের বলি প্রতারক তথ্য নিয়েছে, আপনারা এই নম্বর থেকে ট্রানজেকশনটা বন্ধ করে দেন। টাকা ট্রানজেকশন হয়ে গেলে এটা বের করতে কঠিন হয়ে যায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভিকটিম অভিযোগ করেন না।’

সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার কামরুল আহসান বলেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা ছোট ছোট অংকের টাকা প্রতারকের কাছে খোয়ান। এই অল্প টাকার কারণে তারা মামলা করেন না। সে কারণে অপারেশনও ওভাবে হয় না। ফলে প্রতারকরা থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন্স শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা শুধু বিকাশের ক্ষেত্রে নয়, সকল ক্ষেত্রে হচ্ছে। প্রতারকরা বিভিন্ন রকম কথার ফাঁদে ফেলে এই প্রতারণা করে। পিন নম্বর ও ওটিপি এই দুইটা হচ্ছে মূল বিষয়। ফোনে যখন কোনো কোড আসে, এগুলো কাউকে বলার জন্য আসে না। আমার নিজের জন্য আসে। সব সময় আমরা বলছি, এই সচেতনাটা দরকার। যখনই কেউ এই কোড নম্বর চাইবে, তখনই মনে করতে হবে সে প্রতারক। কারণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান কখনই এ ধরনের কোড চাইবে না।’

এ বিভাগের আরো খবর