স্কুলে যাওয়ার অপেক্ষায় স্বরিৎ ঋতি ভোর। বয়স তার সোয়া চার বছর। স্বাভাবিক সময়ে এই বয়সের আগেই শিশুরা স্কুলে যাওয়া শুরু করে।
রাজধানীতে বেসরকারি স্কুলগুলোতে প্রাক প্রাথমিকে প্লে গ্রুপ, নার্সারি, কেজি ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে কেজি টু পার হওয়ার পর প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়।
ভোরকে তার বাবা-মা ভর্তি করাতে চান ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে। এখনও ক্লাস শুরু না হলেও প্লে-তে ভর্তি নেয়া হচ্ছে আগে থেকেই।
জুলাই থেকে জুন শিক্ষাবর্ষে ভোরকে এখন ভর্তি করা হলে ক্লাস ওয়ানে উঠতে উঠতে তার বয়স আট বছর পার হয়ে যাবে।
এ কারণে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতে সাধারণত তিন বছর থেকেই শিশুদের ভর্তি করা হয়, যা করোনার কারণে সম্ভব ছিল না। ২০২০ সালের মার্চ থেকেই বন্ধ সব স্কুল। আর ১৭ মাস পর গত ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল খুললেও এখনও প্রাক-প্রাথমিকে ক্লাস শুরু হয়নি।
ভোরের মতোই লাখ লাখ শিশুর শিক্ষাজীবন শুরু হতে দেরি হয়েছে। যারা আগে থেকে স্কুলে ভর্তি ছিল, তারা অনলাইনে ক্লাস করলেও একেবারে প্লে গ্রুপের শিশুদের এভাবে ক্লাস করানো কঠিন। তাছাড়া এ বয়সে ভোরকে অনলাইন ক্লাসে অভ্যস্ত করতে রাজিও ছিলেন না তার বাবা-মা।
ভোরের মায়ের এ উদ্বেগের বিষয়টি উঠে এসেছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে। সেখানে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষার স্তর পর্যন্ত ৪ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব শিশু শুরুর বছরগুলোতে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ে, তারা প্রায় ক্ষেত্রেই স্কুলে কাটানো অবশিষ্ট সময়ের জন্য পিছিয়ে থাকে এবং বছরের পর বছর এই ব্যবধান বাড়তে থাকে। একটি শিশুর প্রাপ্ত শিক্ষাবছরের সংখ্যা তার ভবিষ্যতের আয়ের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা জান্নাত আক্তারের দুশ্চিন্তা আরও বেশি। তার ছেলে আরিয়ান হোসেনের বয়স এখন ৬ বছর। কিন্তু সে এখনও স্কুলে যায়নি। ফলে তার শিক্ষাজীবন আরও পিছিয়ে যাবে।
নিউজবাংলাকে জান্নাত বলেন, ‘পরিকল্পনা ছিল ৫ বছরে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করার। কিন্তু করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তা সম্ভব হয়নি। এখন কোন ক্লাসে ভর্তি করব, তা নিয়ে চিন্তায় আছি। তাছাড়া আমরা চাইলেই স্কুলগুলো ওপরের ক্লাসে ভর্তি নেবে কি না, তাও জানি না।’
মগবাজারের বাসিন্দা অর্পিতা সাহা বলেন, ‘করোনার কারণে ৫ বছরের ছেলে শুভ্র সাহাকে সঠিক সময়ে স্কুলে ভর্তি করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ছেলে প্রতিদিনই স্কুলের ড্রেস পরে তৈরি হয়ে বাসায় বসে থাকে। আর সব বিষয়ে জেদ করে।’
মেয়ের শিক্ষার বয়স পিছিয়ে যাওয়ায় চিন্তিত মা নাহিদা খানম। নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্কুলে যাওয়া শুরু করলে মেয়ের সঠিক সময়ে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তৈরি হতো, এখন ঘুম থেকে ওঠে বেলা করে।
‘ঘরে একা থাকার কারণে কথা বলাতে তার জড়তাও রয়ে গেছে। মোবাইল ফোন আর টেলিভিশনে আসক্ত হয়ে পড়েছে। সে খেলাধুলা করতে চায়, তবে ঘরে তো সুযোগ কম। আগে পার্কে গেলেও করোনায় কয়েক মাস বন্ধ থাকায় অনভ্যস্ততার কারণে এখন আর যেতে চায় না।’
নাহিদা খানম বলেন, ‘জীবনের শৃঙ্খলা স্কুলে যাওয়ার মাধ্যমেই শুরু হয়। স্কুলে না যাওয়ায় মেয়েটা পিছিয়ে পড়েছে। শিক্ষাজীবন শুরু হতে না হতেই মেয়েটার জীবন থেকে এক বছর হারিয়ে গেল।’
সমাধান কী?
শুরুতেই পিছিয়ে পড়া এ শিশুদের নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনার তাগিদ এসেছে শিক্ষাবিদদের পক্ষ থেকে।
প্রাক-প্রাথমিকে পড়াশোনার চাপ কম থাকায় শিক্ষাবর্ষ ১২ মাসের বদলে কমিয়ে আনার পরামর্শ এসেছে। আবার ক্লাসে চাপ না দিয়ে শিশুদের সংবেদনশীলতার সঙ্গে যত্ন নিয়ে পড়ানোর তাগিদও এসেছে। প্রাক-প্রাথমিকে সনাতন পরীক্ষাপদ্ধতি তুলে নেয়ার কথাও বলছেন কেউ কেউ।
ছয় বছর বয়সী আরিয়ান হোসেন এখনও স্কুলে যায়নি। তাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত তার বাবা-মা
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও কম্পিউটার বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশেই বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। বিষয়টিকে বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে।
‘আর যেসব শিশুর জীবন থেকে এক অথবা দুটি বছর হারিয়ে গেল, তাদের প্রতি বিশেষ যত্নবান হতে হবে। কেননা দীর্ঘদিন বাসায় থাকার ফলে তাদের মানসিক ও দৈনন্দিন জীবনযাপনে বিভিন্ন পরির্বতন এসেছে। তাই শিক্ষক ও অভিভাবকদের বিশেষ যত্নবান হতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও মনে করেন, ‘যে সময়টুকু চলে গেছে তা মেনে নিয়েই আমাদের সামনের দিকে এগোতে হবে।’
শিশুদের শিক্ষাজীবনের গ্যাপ কমানোর জন্য শিক্ষকদের বিশেষ ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানান তিনি। বলেন, ‘গ্যাপ কমাতে শিক্ষকদের একটু বেশি পরিশ্রম করতে হবে। তবে শিশুদের ওপর অতিরিক্ত চাপ না দেয়ার বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। আর পড়াশোনাকে আনন্দদায়ক করার ক্ষেত্রে মনোযোগী হতে হবে।’
আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক (শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘শিশুর জীবন থেকে কয় বছর অথবা কোন ক্লাস পার হলো, এটাকে বিবেচ্য না করে শিক্ষার্থী এই সময়ে কতটুকু শিক্ষা অর্জন করল, সেদিকে নজর দেয়া উচিত।’
তার মতে, প্রাক-প্রাথমিকে শিক্ষাবর্ষের সময় কমানো যেতে পারে। এক বছরের বদলে ৮ বা ৯ মাস করা যায়। এ জন্য আগামী পাঁচ বছরের পরিকল্পনা করতে হবে। তাহলে যাদের জীবন থেকে এক বছর হারিয়ে গেছে, সেটি ফিরে পাবে।
করোনার কারণে দীর্ঘদিন ঘরবন্দি শিশুদের ক্লাসমুখী করতে বিশেষ পরিকল্পনা প্রয়োজন বলে মনে করেন সেন্ট জোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের প্রিন্সিপাল ব্রাদার লিও পেরেরা।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে বেশির ভাগ প্রাক-প্রাথমিক স্কুলের ক্ষেত্রেই (কিছু ইংরেজি মাধ্যম ছাড়া) বইনির্ভর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কিন্তু শিক্ষাবিদরা চান শিক্ষার্থীরা যতটা বই পড়বে তার চেয়ে বেশি খেলাধুলা/গানবাজনা, চিত্রাঙ্কন ইত্যাদি করবে। এগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার সঙ্গে তাদের পরিচয় করে দেয়া ও প্রস্তুত করা। এ বিষয়গুলোর প্রতি এখন বেশি করে জোর দিতে হবে।’
গতানুগতিক ক্লাস নেয়ার বিপক্ষে কথা বলেন এই শিক্ষক। বলেন, ‘প্রথমে তাদের স্কুলে আসার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। লম্বা সময় ধরে ক্লাস না নিয়ে আগে তাদের পড়ার জন্য প্রস্তুত করতে হবে।’
এসওএস হারমান মেইনার স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ রাফিয়া আক্তার বর্তমান বাস্তবতা মেনে দ্রুত প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের ক্লাস করার সুযোগ দেয়ার পক্ষে।
তিনি বলেন, ‘অন্যান্য ক্লাসের মতো এক দিনের জন্য হলেও প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের স্কুলে আসার সুযোগ দিতে হবে।’
দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকায় শিশুরা মানসিকভাবে চাপে থাকে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহজাবীন হক। তিনি বলেন, ‘তারা ঘন ঘন বিরক্ত ও হতাশ হতে পারে, আবার তাদের দুষ্টুমিও বেড়ে যেতে পারে। এ জন্য শিক্ষক ও অভিভাবকদের বিশেষ যত্নবান হতে হবে।’