গভীর সমুদ্রের অন্যতম দ্রুতগতির মাছ সেইল ফিশ। স্থানীয় লোকজন একে বলে পাখি মাছ। গত মাস থেকে বরগুনার স্থানীয় বাজারে প্রায় প্রতিদিনই বিক্রির জন্য দেখা মিলছে এই বিশালাকার মাছের। নদীতে ও মোহনায় গভীর সমুদ্রের মাছ এভাবে ধরা পড়ার বিষয়টিকে উদ্বেগজনক মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের ধারণা, দূষণের কারণে খাদ্য সংকট ও বিচরণক্ষেত্র অনুপযোগী হওয়ায় মাছগুলো নদীতে উঠে আসছে।
এ বছর প্রথম পাখি মাছ ধরা পড়ার কথা জানা যায় গত ২৫ জুলাই লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে মেঘনা নদীতে। সাত ফুট লম্বা মাছটির ওজন ছিল প্রায় ২২ কেজি।
২৯ জুলাই ও ১০ আগস্ট বরগুনার পাথরঘাটায় ধরা পড়ে আরও দুটি পাখি মাছ। ১০ আগস্ট ধরা পড়া ১০ ফুট দৈর্ঘ্যের ও প্রায় ২ মণ ওজনের মাছটি বিক্রি হয় ৪২০০ টাকা মণ হিসেবে।
এরপর থেকে আগস্ট মাসজুড়ে বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে প্রতিদিন গড়ে ১৫টি পাখি মাছ আসে।
বাংলাদেশ ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তফা চৌধুরী নিউজবাংলাকে জানান, পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে এখন পর্যন্ত তিন শতাধিক পাখি মাছ বিক্রি হয়েছে। গত ২৬ আগস্ট পটুয়াখালীর মহিপুরের নুরুন্নবী নামের এক জেলের জালে ধরা পড়ে আটটি পাখি মাছ।
২৪ ঘণ্টা পরই পটুয়াখালীর মহিপুর মৎস্যবন্দরে ১৫টি পাখি মাছ নিয়ে যান জেলেরা।
পটুয়াখালীর মহিপুর আলীপুর মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি আনসার উদ্দীন মোল্লা জানান, আগস্টের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এখানে প্রায় ২০০টি পাখি মাছ নিয়ে এসেছেন জেলেরা।
এখন পর্যন্ত কক্সবাজার বিএফডিসি ঘাটে ৬ শতাধিক পাখি মাছ বিক্রি হয়েছে বলে জানান কক্সবাজার ফিশারি ঘাটের মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির পরিচালক জুলফিকার আলী।
বরগুনার পাথরঘাটা কালমেঘা এলাকার দুলাল সারা জীবন কাটিয়েছেন সমুদ্রে মাছ ধরে।
তিনি বলেন, ‘যহন সাগরের গভীরে যাইতাম, তহন মোগো জালে ভুল কইরা দু-একটা পাখি মাছ আটকাইয়া যাইত। এই বচ্ছর সাগরের মোহনায় অনেক পাখি মাছ পাইছি।’
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিসুর রহমান জানান, পাখি মাছ বা সেইল ফিশের বৈজ্ঞানিক নাম istiophorus platypterus. ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এ ধরনের মাছ পাওয়া যায়। এর পিঠের পাখনাটি অনেকটা নৌকার পালের মতো দেখতে হওয়ায় সেইল ফিশ বলা হয়। অ্যাটলান্টিক সেইল ফিশ নামে এর আরও একটি প্রজাতি আছে।
তিনি জানান, আমেরিকার ন্যাশনাল ওশান সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, পাখি মাছ ঘণ্টায় ১১০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে। ৯১৫ মিটার নিচ পর্যন্ত এরা চলাচল করে। সমুদ্রের তীর থেকে ৫০ কিলোমিটার আয়তনের মধ্যেই এদের বাস। মাঝেমধ্যে তীরের কাছাকাছি এলেও কখনও নদীতে ঢোকে না।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) ২০০০ সালে একে লাল তালিকাভুক্ত করে।
বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এনভায়রনমেন্টাল ওশানোগ্রাফি ও ক্লাইমেট বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সুলতান আল নাহিয়ান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাধারণত প্রজননকালে সমুদ্রের বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী মোহনার দিকে উঠে আসে। তবে হঠাৎ করে এ বছর নদীতে ও সমুদ্রের মোহনায় পাখি মাছের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক।
‘বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট দূষণের কারণে বঙ্গোপসাগরের প্রাণীদের জীবনধারায় পরিবর্তন ঘটতে পারে বলে আমি মনে করি। এ নিয়ে গবেষণা জরুরি। ঠিক কী কারণে মাছগুলো মোহনার দিকে ছুটে আসছে, খাদ্যসংকট নাকি দূষণের কারণে বসবাসস্থল অনুপযোগী হয়ে যাওয়ায়, তা নিয়ে মৎস্য বিজ্ঞানীদের ভাবা উচিত।’
এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘প্রাণীদের জীবনধারায় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্লাস্টিক পলিউশন একটি উদ্বেগজনক কারণ। বঙ্গোপসাগর এখন একটি প্লাস্টিকের ট্র্যাশবিনে পরিণত হয়েছে। এতে মাছের প্রজননস্থল নষ্ট হচ্ছে, যা সরাসরি সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ওপর প্রভাব ফেলছে। অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।’
২০১৯ সালের অক্টোবর মাসের শেষদিকে পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ‘উৎস থেকে সাগরে’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়, পদ্মা নদী থেকে প্রতিবছর ৩০০ ধরনের প্লাস্টিক-পণ্য সাগরে পড়ছে। বঙ্গোপসাগরে যুক্ত হওয়া বর্জ্যের মধ্যে কোমল পানীয়ের বোতল থেকে শুরু করে থালা, কসমেটিকসের মোড়ক ও নিত্যব্যবহার্য নানা জিনিস রয়েছে। এই বর্জ্যের উৎস গঙ্গা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দেশ চীন, ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ।
২০১৮ সালে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইউএনইপি এক গবেষণার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিদিন প্রায় ৭৩ হাজার টন বর্জ্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে। বাংলাদেশে এককভাবে দিনে ৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। এর কিছু অংশ নদী দিয়ে সমুদ্রে যায়। বেশির ভাগ বর্জ্য ভারত, নেপাল ও চীন থেকে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র দিয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সমুদ্রে পড়ছে।
বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, ‘হঠাৎ করে মোহনা ও নদীতে সেইল ফিশের বিচরণ উদ্বেগজনক। এ নিয়ে গবেষণা জরুরি। তবে আমাদের লোকবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট নেই। এসব সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা গবেষণা করতে পারছি না। সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে আমরা যত দ্রুত সম্ভব গবেষণা শুরু করব।’
সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের অবস্থা নিয়ে গবেষণা ও মৎস্য সম্পদ জরিপের সঙ্গে যুক্ত সমুদ্রবিজ্ঞানী সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘সেইল ফিশ যে পরিমাণে ধরা পড়তে শুরু করেছে, এটা আমাদের সায়েন্টিফিক কমিউনিটির জন্য খুবই উদ্বেগের। গালফ অফ থাইল্যান্ড যেমন অনেকটা মৎস্যশূন্য হয়ে গেছে, তেমন আমাদের বে অফ বেঙ্গল মৎস্যশূন্য হয়ে যাক তা আমরা চাই না।’