পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে বন্ধ থাকা রিংসাইন টেক্সটাইলে প্রাণ ফেরাতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির উদ্যোগ আরও একটু এগিয়ে যাচ্ছে।
এরই মধ্যে দুটি ইউনিটে উৎপাদন চলতে থাকা কোম্পানিটিতে আরও একটি ইউনিটে কাজ শুরুর প্রস্তুতি চলছে বলে বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে থাকা বিএসইসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
২০১৯ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি পরের বছর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা তাদের টাকা ফিরে পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েন। এই পরিস্থিতিতে বিএসইসি গত ২৭ জানুয়ারি কোম্পানিটির বোর্ড পুনর্গঠন করে আগের পরিচালকদের বাদ দিয়ে দেয়।
বিএসইসি এখন পর্যন্ত ১৩টি কোম্পানির পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় কোম্পানি হিসেবে রিংসাইনে উৎপাদন শুরু হয়। গত ১৩ জুন ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে দেয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে কোম্পানিটি জানায়, তারা তাদের উৎপাদনক্ষমতার এক-চতুর্থাংশ ব্যবহার করছে।
এখন আরও একটি ইউনিট চালু হলে উৎপাদনক্ষমতার ৩৭.৫ শতাংশ ব্যবহার নিশ্চিত হবে। পর্যায়ক্রমে তা আরও বাড়ানো হবে।
জানতে চাইলে বিএসইসি মনোনীত স্বতন্ত্র পরিচালক সগীর আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর কোম্পানিটির উৎপাদন চালু আছে। উৎপাদনও বাড়ছে।’
নতুন কোনো প্ল্যান্ট শিগগিরই চালু হবে কি না প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যে দুটি চালু করা হয়েছে, সেগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত করার পর প্রয়োজনে আমরা নতুন প্ল্যান্ট চালুর দিকে যাব। প্রয়োজনে আইপিওর যে টাকা রাখা আছে, সেগুলোরও ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হবে।’
রিংসাইনের ক্ষেত্রে নতুন বোর্ড আরেকটু সুবিধাজনক অবস্থায় আছে এ কারণে যে, আইপিওর মাধ্যমে কোম্পানিটি যে ১৫০ কোটি টাকা তুলেছিল, তার পুরোটাই ব্যাংকে রক্ষিত ছিল। এর মধ্যে বিএসইসির অনুমতি পেয়ে ৪০ কোটি টাকায় দায়দেনা পরিশোধ করা হয়েছে। আর বাকি অর্থে শুরু হয় উৎপাদন।
ফলে আরও ১১০ কোটি টাকা ব্যবহারের সুযোগ আছে নতুন পর্ষদের কাছে। কোম্পানির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রস্তাব এলে তা খতিয়ে দেখে অনুমতি দেবে বিএসইসি।
শেয়ার বাতিলে আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত
বিএসইসির সেই কর্মকর্তা বলেন, ‘কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে টাকা ছাড়াই যে ২৭ কোটি শেয়ার ইস্যু করা হয়েছিল, সেগুলো বাতিল হবে। এ-সংক্রান্ত আমাদের তদন্ত প্রায় শেষ। এখন তা কমিশন সভায় উপস্থাপন করার বাকি। আগামী মাসেই তা উপস্থাপন করা যাবে।’
তিনি বলেন, ‘কমিশন শেয়ার বাতিল করতে পারে না। শেয়ার বাতিলের অংশ চূড়ান্ত হওয়ার পর তা কোম্পানিটিকে আদালতে গিয়ে অবৈধ শেয়ারগুলো বাতিল করার জন্য বলা হবে। কোম্পানি তখন সে শেয়ারগুলো বাতিল করবে।’
তবে রিংসাইনের মনোনীত পরিচালক সগীর আহমেদ বলেছেন, ‘এটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বিএসইসি। আমাদের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।’
আইপিওতে আসার আগে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ছিল ৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। উদ্যোক্তা বা পরিচালক ও ৭৩ জন সাধারণ শেয়ারধারীর কাছে ২৭৫ কোটি ১০ লাখ টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে এই পরিশোধিত মূলধন ২৮৫ কোটি ৫ লাখ টাকা করা হয়। এর বিপরীতে কোনো টাকা পরিশোধ করা হয়নি।
বন্ধ হয়ে যাওয়া রিংসাইনে প্রাণ ফিরছে বিএসইসির উদ্যোগে
রিংসাইনের বোর্ড পুনর্গঠনের পর তদন্ত করে এই বিষয়টি উদঘাটন করে বিএসইসি। এর পরে এসব শেয়ার বাতিলের বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়।
২৭ কোটি ৫১ লাখ শেয়ার বাতিল হলে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন হবে ২২৫ কোটি ২১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। শেয়ার সংখ্যা হবে ২২ কোটি ৫২ লাখ ১৩ হাজার ৪৩টি।
অর্থাৎ বর্তমানে কোম্পানিটির যে শেয়ার দেখানো হচ্ছে, তার ৫৪ শতাংশই কমে যাচ্ছে।
আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশে চিঠি
বিএসইসির একজন কমিশনার জানান, আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে রিংসাইনকে চিঠি দেয়া হয়েছে।
বিএসইসি মনোনীত পরিচালনা পর্ষদের সদস্য অধ্যাপক সগীর হোসাইন খন্দকার সম্প্রতি নিউজবাংলাকে বলেছেন, তারা আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে এজিএম করবেন। সেখানে কোম্পানির সবশেষ পরিস্থিতি জানানো হবে বিনিয়োগকারীদের।
তালিকাভুক্তির বছরে ২০১৯ সালে বিনিয়োগকারীদের জন্য ১৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়েছিল রিংসাইন। ২০২০ সালে ১ শতাংশ বোনাস ও ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করা হলেও বার্ষিক সাধারণ সভা করে সেটি অনুমোদন করা যায়নি। এর মধ্যে করোনার সময় কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর কোনো একটা কিছু হচ্ছে- এমন তথ্য পেয়ে কোম্পানির আইপিও ফান্ড আটকে দেয় বিএসইসি।
উৎপাদন শুরু হলেও এবার জুনে অর্থবছর শেষে বোর্ডসভায় ২০২১ সালের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
উৎপাদন চালু হলেও কোম্পানির আর্থিক হিসাব প্রকাশ না করার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক সগীর জানান, উৎপাদনে আসার পর কোম্পানি মুনাফা করছে। তবে তাদের আগের লোকসান আছে। সেগুলো সমন্বয় করে হিসাব-নিকাশ করতে একটু সময় লাগছে।
কবে নাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ হতে পারে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের নতুন সিএফও যোগদান করেছেন। তিনি এ বিষয়টিকে দেখছেন। দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ থাকা একটি কোম্পানির পরিপূর্ণ হিসাব তৈরি করা সময়সাপেক্ষ বিষয়। তবে তা প্রকাশ করা হবে।’
তালিকাভুক্তির পরই ভেঙে পড়ে কোম্পানিটি
প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে তোলা টাকায় যন্ত্রপাতি ক্রয়, ঋণ পরিশোধ এবং আইপিওর খরচ মেটানোর কথা ছিল। তবে সেই টাকা তারা ব্যবহার করার আগেই হস্তক্ষেপ করে বিএসইসি।
কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরু করার আগেই ২০১৯ সালের জন্য ১৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করে। লভ্যাংশ ঘোষণার পরবর্তী লেনদেনে সার্কিট ব্রেকার থাকবে কি থাকবে না, এমন অবস্থায় কোম্পানিটি নিয়ে তৈরি হয় জটিলতা। ১২ ডিসেম্বর কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরু করে।
পরের বছরের জন্য কোম্পানিটি ১ শতাংশ করে নগদ ও বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে ঘোষণা করে কিন্তু বার্ষিক সাধারণ সভা আর হয়নি। ফলে বিষয়টি আর চূড়ান্ত হয়নি।
যদিও কোম্পানিটি বিশেষ সাধারণ সভার তারিখ ঘোষণা করে, যার উদ্দেশ্য ছিল প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও থেকে তোলা টাকার ব্যবহারের খাত পরিবর্তন।
তখন অভিযোগ ওঠে, কোম্পানিটির বিদেশি পরিচালকরা আইপিওর মাধ্যমে তোলা টাকা নিয়ে নিজ দেশে চলে গেছেন। তখন বিএসইসির অনুরোধে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে কোম্পানির ব্যাংক হিসাব বন্ধ করে রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক।
যেভাবে বিপাকে
ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ডিইপিজেড) তাইওয়ানের মালিকানাধীন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান রিংসাইন একটি শক্তিশালী কোম্পানি হিসেবেই পরিচিত ছিল। এর শ্রমিকসংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি ছিল।
১৯৯৬ সালে ডিইপিজেডে তাইওয়ানের নাগরিক মি সাও সোয়েটার কারখানাটি চালু করেন। ব্যবসায়িক সাফল্যে একে একে তিনি গড়ে তোলেন অ্যাভাস গার্ড লিমিটেড, সাইন ফ্যাশন লিমিটেড ও ইন্টার লগ লিমিটেড। এসব কারখানায় শ্রমিক ছিল আরও অন্তত সাত হাজার।
সমস্যার শুরু পাঁচ বছর আগে। বার্ধক্যজনিত কারণে মি সাও মারা গেলে তার ছেলে মি উইং থিং ও মেয়ে অ্যাঞ্জেলা কারখানাটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু শ্রমিক ফেডারেশন নেতা ও কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে তারা পেরে ওঠেননি।
মালিকদের অভিযোগ, শুল্কমুক্ত সুবিধা নিয়ে আমদানি করা সুতাসহ নানা উপকরণ পাচার করে দিচ্ছিলেন শ্রমিক ফেডারেশন নেতা ও কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
মি সাওয়ের মতো তার সন্তানরা ব্যবসা অতটা ভালো বুঝতেন না। আর এই সুযোগে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশ বেপরোয়া হয়ে ওঠে বলেও তথ্য আছে। একপর্যায়ে মি সাওয়ের দুই সন্তান কাউকে না বলে বাংলাদেশ থেকে চলে যান।