বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

গাড়ির কালো ধোঁয়া দেখবে কে

  •    
  • ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৮:৪২

রাজধানীর বাতাসে দূষণ এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। যানবাহন থেকে বের হওয়া কালো ধোঁয়া এর প্রধান উৎস। কিন্তু এটি নিয়ন্ত্রণের দায় কার? বিআরটিএ, পরিবেশ অধিদপ্তর নাকি ট্রাফিক পুলিশ?

সকাল ১০টা। রাজধানীর মৌচাক-মালিবাগ মোড়ে জ্যামে থেমে আছে ছোট বড় অনেক গাড়ি। হুট করে জ্যাম ছাড়লেই কে কাকে রেখে ছুটবে এই প্রতিযোগিতা। তবে জ্যামে আটকে থাকা বাসগুলো যেন কালো ধোঁয়ার ফোয়ারা ছুটিয়ে চলছে।

এমন দৃশ্য এখন ঢাকার প্রায় সব জায়গাতেই।

মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া নির্গত হলে তা জরিমানাসহ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

২০০২ সালের ৩১ ডিসেম্বর টু স্ট্রোক বেবি ট্যাক্সিসহ পুরাতন যানবাহন বন্ধের পর এক দিনে ঢাকার বায়ুতে দূষণের মাত্রা কমে যায় প্রায় ৩০ শতাংশ। তবে ২০১৩ সাল থেকে তা আবারও বাড়তে থাকে। গত আট বছরে সেই দূষণ বাড়তে বাড়তে তা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ২০২০ সালের জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীর বাতাসকে দূষণে ভারী করে তুলছে যানবাহনের ধোঁয়া। বায়ুদূষণের জন্য এখন ৫০ ভাগ দায়ী মূলত তরল জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে তৈরি হওয়া এই ধোঁয়া। আর এই তালিকায় আছে বাস, লেগুনা, ব্যক্তিগত গাড়ি ও মাইক্রোবাস।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুদূষণ বিষয়ক গবেষক অধ্যাপক আবদুস সালাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের গাড়িগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণ ধোঁয়া আসে। আমাদের আশপাশের কারখানা, নির্মাণকাজ আর যেসব ময়লা আগুনে পোড়ানো হয়, সেখান থেকেও ধোঁয়া আসে। আমরা যদি পদক্ষেপ নেই, তবেই নির্মল বাতাস আশা করতে পারি।’

এক সময় ঢাকায় বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় উৎস ছিল ইটের ভাটা। প্রায় ৫৮ ভাগ বায়ুদূষণ ঘটত ইটের ভাটা থেকে। তবে রাজধানীর বাতাসকে এখন বিষিয়ে তুলছে যানবাহনের ধোঁয়া।

সন্তানকে বায়ুদূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে মায়ের প্রচেষ্টা। ছবি: সাইফুল ইসলাম

গত এক সপ্তাহে রাজধানীর কয়েকটি প্রধান সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, মিনিবাস ও লেগুনা থেকে ধোঁয়া নির্গত হওয়ার পরিমাণ বেশি। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মতিঝিলগামী অনেক বাস থেকে কালো ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব অনুযায়ী, দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির সংখ্যা ৪ লাখ ৮১ হাজার ২৯টি, যেগুলো থেকে কালো বিষাক্ত ধোঁয়া বের হয়। ফিটনেসবিহীন গাড়ি থেকে যে কালো ধোঁয়া বের হয়, তার সুক্ষ্ম কণা বাতাসে মিলে তৈরি করছে কালো কার্বন, যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, রাজধানীতে ফিটনেসবিহীন গাড়ির কালো ধোঁয়া ও নির্মাণকাজ থেকে প্রচুর ধুলা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, যা নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকছে।

মাত্রার চেয়ে বেশি কালো ধোঁয়া ছড়ায় যেসব যান, তা জব্দ করাসহ বায়ুদূষণ রোধে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি ৯ দফা নির্দেশনা দেয় উচ্চ আদালত। এরপর গত ২৪ নভেম্বর এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয় উচ্চ আদালত।

গত কয়েক বছরে ঢাকার রাস্তায় তৈরি হয়েছে কালো ধোঁয়ার আধিক্য। সেই সঙ্গে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও রাস্তার পাশে জমে থাকা ধুলা রাজধানীর বায়ুকে দিন দিন বিষিয়ে তুলেছে। ঢাকায় গত ১৬ বছরে মাত্র কয়েক দিনের জন্য নির্মল বাতাসের দেখা পাওয়া গিয়েছিল এ বছর জুলাই মাসে। আর সেটি সম্ভব হয় লকডাউন ও ঈদের ছুটির কারণে।

২০২১ সালের হিসাবে, দেশে নিবন্ধিত মোটরযান আছে ৪৭ লাখ ২৯ হাজার ৩৯৩টি। এর মধ্যে রাজধানীতে রয়েছে ১৬ লাখের বেশি গাড়ি। ২০২০ সাল থেকে প্রায় ২ লাখ বেশি গাড়ি এক বছরে নিবন্ধিত হয়েছে।

মূলত ফিটনেসবিহীন এবং মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন থেকে কালো ধোঁয়া বেশি ছড়ায়। যানবাহনের ফিটনেস সনদ দিয়ে থাকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআরটিএ-এর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করি। তবে কালো ধোঁয়া নির্গত হয় যেসব গাড়ি থেকে, সেটি পরিমাপ করার যন্ত্র এখন আমাদের কাছে নেই। তাই আমরা সেই বিষয়ে আলাদা করে অভিযান করি না বা করতেও পারি না।’

ঢাকার বাতাস দূষণ নিয়ে প্রায়ই খবরের শিরোনাম হয়। ছবি: সাইফুল ইসলাম

পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে এমন অভিযান করা হয় জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সাধারণত যখন পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান পরিচালনা করে, তখন তারা এমন যন্ত্র নিয়ে করে থাকে। আমরা এই যন্ত্র তাদের থেকে নেয়ার পরিকল্পনা করছি।’

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা অভিযান পরিচালনা করছি। পরিবেশ বিধিমালা এই বছরের জানুয়ারিতে সংশোধন করা হয়েছে।’

গাড়ির কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণের একটা বড় দায়িত্ব থাকে ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তাদের ওপর। তবে রাস্তায় দেখা গেছে, ট্রাফিক পুলিশের সামনে দিয়েই গাড়ি কালো ধোঁয়া নির্গত করে চলে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ফিটনেসবিহীন গাড়ি আটক করা হলেও সেটি ছাড় পেয়ে যাচ্ছে।

হাতিরঝিলে পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসা সাইফুল আলম অনেকটা বিরক্তি নিয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভাই ঢাকায় এখন রাস্তায় বের হওয়া দায়। আগে শুধু জ্যামের অজুহাত ছিল। এখন ঠিকমত নিঃশ্বাস নিতে পারি না।’

রাজধানীর রামপুরা থেকে বাড্ডা হয়ে কুড়িল যাবার রাস্তায় সকাল ও বিকেলের একটা বড় সময় জ্যাম থাকে। জ্যামের সঙ্গে থাকে গাড়ির কালো ধোঁয়ার আধিক্য। এই রুটে কয়েকটি স্থানে ট্রাফিক দায়িত্বে থাকলেও দূষণ নিয়ন্ত্রণে আলাদা কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি।

গুলশান বিভাগের ট্রাফিকে উপপুলিশ কমিশনার মো. রবিউল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিদিন আমাদের সার্বিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আমরা ফিটনেস সার্টিফিকেট দেখি। এটা আমাদের রেগুলার ওয়ার্ক। কালো ধোঁয়া কোনো গাড়ি থেকে নির্গত হলেই আমরা সেটিকে আটক করি। সেটির ফিটনেস কাগজ দেখি। এটা চলমান প্রক্রিয়া।

‘তবে পরিবেশকেন্দ্রিক কালো ধোঁয়ার যে প্রভাব, সেটি নিয়ে আমরা আলাদা অভিযান করি না। আমাদের ট্রাফিক যারা আছেন, তারা যদি দেখেন কোনো গাড়ি থেকে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে, তবে সেটিকে তারা আটক করেন। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়।’

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ডিন ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এক সময় ঢাকায় বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় উৎস ছিল ইটের ভাটা। প্রায় ৫৮ ভাগ বায়ুদূষণ ঘটত ইটের ভাটা থেকে। কিন্তু এখন ইটের ভাটার দূষণকে ছাড়িয়ে গেছে নির্মাণকাজ এবং গাড়ির ধোঁয়া। সড়ক নির্মাণ ও মেগা প্রজেক্টের কারণে প্রায় ৩০ ভাগ বায়ুদূষণ হচ্ছে। ইটের ভাটা থেকে এখন ৩০ ভাগ, যানবাহন থেকে ১৫ ভাগ, বর্জ্য পোড়ানো থেকে ৯ ভাগ দূষণ হয়।’

এ বিভাগের আরো খবর