হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আমির আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর এক বছর হলেও নড়ছে না তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে হওয়া হত্যা মামলার বিচার। পুলিশের তদন্ত সংস্থা পিবিআই মামলাটির প্রতিবেদন ১২ এপ্রিল আদালতে জমা দিলেও এখনও শুরু হয়নি বিচার কার্যক্রম।
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান আহমদ শফী। এর আগের দুই দিন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় হাঙ্গামার ঘটনা ঘটে। মাদ্রাসায় বাবুনগরীর অনুসারীরা এসময় হেফাজতের আমিরের কক্ষে ভাঙচুর চালিয়ে তাকে নানা হুমকি-ধমকি দিয়েছিলেন বলে তার স্বজনরা অভিযোগ করেছেন।
শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর প্রায় তিন মাস পর চট্টগ্রাম জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম শিবলু কুমার দের আদালতে আহমদ শফীকে মানসিক নির্যাতন করে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ এনে মামলা করেন তার শ্যালক মোহাম্মদ মাঈনুদ্দিন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে পিবিআইকে তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়।
আল্লামা শফীর এক নাতনির লেখা পুস্তিকায় বলা হয়েছে, আল্লামা শফীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা ছাড়াও তার চিকিৎসায় বাধা দেয়া হয়েছে। অক্সিজেনের নল কেটে ফেলা হয়েছে, এমনকি অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে দেয়া হয়নি। আর এ কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।
হাটহাজারী মাদ্রাসায় হাঙ্গামার পর হেফাজতের সে সময়ের আমির শাহ আহমেদ শফীকে যখন হাসপাতালে আনা হয়, তখনই তার জীবন ছিল সংকটাপন্ন। ফাইল ছবি
পুলিশের তদন্ত সংস্থা পিবিআই তদন্ত করে ‘অপরাধজনিত নরহত্যার’ অভিযোগ এনে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। গত ১২ এপ্রিল আদালতে জমা দেয়া প্রতিবেদনে ৪৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
তাদের মধ্যে শফীর পর হেফাজতের আমির হওয়া জুনায়েদ বাবুনগরীর নাম ছিল। তিনি মারা গেছেন।
দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি
আল্লামা শফীকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে এই ঘটনার উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার চেয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।
পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার দুই দিন পর গত ১৪ এপ্রিল মন্ত্রী ঢাকায় তার বাসায় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে কথা বলেন বিষয়টি নিয়ে।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘মওলানা শফী সাহেব আমার নির্বাচনী এলাকার ও আমার পাশের ইউনিয়নের একজন আলেম ছিলেন। তার মতাদর্শ নিয়ে নানা কথা থাকলেও মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন সজ্জন। যারা মামলা করেছেন, তারাও আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষ। আমি চাই, আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষ মওলানা শফী সাহেবকে যারা নির্যাতন করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে, তাদের উপযুক্ত দৃষ্টান্তমূলক বিচার হোক।’
আল্লামা শফী চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার সাবেক মহাপরিচালকও ছিলেন। তিনি কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড আল হাইয়াতুল উলইয়ার চেয়ারম্যান ও আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়াত বাংলাদেশের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।
আহমদ শফী আলোচনায় আসেন ২০১০ সালে নারীনীতি বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে হেফাজতে ইসলাম গঠন করে।
তবে এই সংগঠনটি তোলপাড় ফেলে দেয় ২০১৩ সালে। সে সময় মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে উঠা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করে সংগঠনটি ঢাকা অবরোধ ডাকে ৫ মে।
মতিঝিলে সমাবেশ করে সেখান থেকে সরে যেতে অস্বীকৃতি জানানোর পর রাতে সেখানেই অবস্থান করে হেফাজত সরকার পতনের দাবি তোলে। রাতে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির যৌথ অভিযানে তারা শাপলা চত্বরের দখল ছাড়ে।
এরপর শুরু হয় নজিরবিহীন গুজব। ওই রাতে হাজার হাজার মানুষকে হত্যার অবাস্তব অভিযোগ তুলে শেষ পর্যন্ত একজনেরও নাম দিতে ব্যর্থ হয় হেফাজত। আর আল্লামা শফী এক পর্যায়ে সরকারের সঙ্গে দূরত্ব ঘুঁচিতে আনেন। কওমিপন্থিদের প্রধান দাবি দাওরায়ে হাদিসকে ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্সের সমমানের স্বীকৃতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার হাতেই তুলে দেন।
তবে আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর হেফাজত আবার সরকারবিরোধী অবস্থানে ফিরে যায়। গত মার্চ ও এপ্রিলের শুরুতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের নানাস্থানে ব্যাপক সহিংসতা চালায় নেতা-কর্মীরা। পরে ধরপাকড় শুরু হলে হেফাজত ‘সমঝোতায়’ মরিয়া হয়ে উঠে।
এর মধ্যে জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যু হলে সংগঠনটি কওমিপন্থিদের মধ্যেও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে অনেকাংশে।
আল্লামা আহমদ শফীর জন্ম ১৯২০ সালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানার পাখিয়াটিলা গ্রামে। ১৯৪১ সালে তিনি ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখান থেকে দাওরায়ে হাদিস শেষ করেন ১৯৪৬ সালে হাটহাজারীতে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠানের মজলিসে শূরার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহাপরিচালক পদে দায়িত্ব পান। ২০০৫ সালে তিনি কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড-বেফাকের সভাপতি নির্বাচিত হন।
ব্যক্তিগত জীবনে আল্লামা শপীর স্ত্রী, দুই ছেলে, দুই মেয়ে, নাতি, নাতনি রয়েছে।