বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিষখালীর ইলিশ দেখতে যেমন, খেতেও তেমন

  •    
  • ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৯:৩৬

পায়রা ও বলেশ্বর বিষখালীর চেয়ে খরস্রোতা, তবে অগভীর। স্রোত বেশি থাকায় পানিতে লবণের মাত্রা বেশি। বিষখালীতে ওই দুটি নদীর চেয়ে স্রোতের তোড় কম থাকায় মিঠাপানি থাকে। এ নদীর গড় গভীরতা ৩০ ফুট। ফলে ইলিশ এখানে দীর্ঘদিন অবস্থান করে ও ঠিকমতো খাবার পায়। এ কারণে বিষখালীর ইলিশ আকারে হৃষ্টপুষ্ট ও স্বাদ বেশি।

‘স্যার, বিষখালীর ইলিশ, খালি সাইজটা দ্যাহেন আতে (হাতে) নিয়া। এই রহম মাছ দ্যাশের কোনোহানে পাইবেন না, তেলে ভরা। ১২০০ টাকা কেজি বেচি।’

বড়সড় একটি ইলিশ হাতে ধরিয়ে দেয়ার সময় এভাবেই বললেন বিক্রেতা জাকির হোসেন।

অন্য দিকে ঘুরতেই আবার ডাক, ‘আপনে যদি লন, একদাম ১১০০ টাহা। ভাই, আপনে শুধু মাছটা ধরেন। ঘাড়ে কত তেল, কত মোটা ধইরা দেহেন। একটা ইলিশ এক কেজির বেশি হইবে’।

বরগুনা শহরের মাছ বাজারে ইলিশের ঝুড়ি নিয়ে বসে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা জাকিরের। একের পর এক ইলিশ তুলছেন দুই হাতে। বাজার ভরা শুধু ইলিশ আর ইলিশ। দেখেশুনে একটু কম দামে অনেকে কিনছেন পছন্দের মাছ।

কয়েকজন বিক্রেতা জানান, বিষখালীর ইলিশ এই অঞ্চলের বিখ্যাত। এই নদীর ইলিশ আকারে বড় ও হৃষ্টপুষ্ট। এ ছাড়া স্বাদে অতুলনীয়। বাজারে এই ইলিশের চাহিদা বেশি, দামও অন্য নদী ও সাগরের ইলিশের তুলনায় একটু বেশি। এ কারণে বিক্রেতারা বিষখালীর ইলিশ আলাদা করে ডেকে ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেন।

রাজধানীসহ দেশব্যপী বিষখালীর ইলিশের প্রচুর চাহিদা। ছবি: নিউজবাংলা

ইলিশ গবেষক ও মৎস্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ডফিশের ইকো-ফিশ প্রকল্পের দলনেতা আবদুল ওহাব জানান, স্বাদ ও আকারে বিষখালীর ইলিশের সুখ্যাতি আছে।

বিষখালীর ইলিশ নিয়ে গবেষণা হলে আরেকটি নতুন বৈশিষ্ট্যের ইলিশ সম্পর্কে জানতে পারবে মানুষ।

আবদুল জলিল নামের এক বিক্রেতা জানান, বিষখালীর ইলিশের মতো স্বাদ এবং বড় আকারের ইলিশ বাংলাদেশের কোথাও পাওয়া যায় না।

জলিল বলেন, ‘সরকারি চাকরি করা এক স্যারে বাজারে আইসাই আমাদের জিগায় বিষখালীর ইলিশ আছেনি। ওই স্যার আমারে কয়, দ্যাশের কত্ত জাগার ইলিশ খাইলাম, এই ইলিশের মতো কোনো ইলিশের স্বাদ নাই।’

জলিলের কথার সত্যতাও পাওয়া যায় তাৎক্ষণিক। সেখান থেকেই চারটি ইলিশ কিনেছেন একজন ক্রেতা। তিনি বরগুনার একটি সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা। ছয় বছর ধরে বিষখালী নদীর ইলিশ খুঁজে কিনে নেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘এই নদীর ইলিশের মতো সাইজ আর স্বাদ দেশের কোথাও নেই।’

বাইনচটকি এলাকায় সম্প্রতি বিষখালী নদীতে জেলের জালে তিন কেজি সাইজের একটি ইলিশ ধরা পড়ে। ওই ইলিশটি স্থানীয় পাইকার ইউনুস মিয়া চার হাজার টাকায় কিনে নিয়ে বরগুনার সাবেক পৌর মেয়র শাহাদাত হোসেনের কাছে ৪৫০০ টাকায় বিক্রি করেন।

ইউনুস জানান, তিনি অনেক বছর ধরে বিষখালীর পাড়ে ইলিশের ব্যবসা করেন। প্রতিবছরই এ নদীতে বড় সাইজের ইলিশ ধরা পড়ে। গত বছর তিন কেজি ৭০০ গ্রাম ওজনের একটি ইলিশ ধরা পড়েছিল। এবার এখন পর্যন্ত তিন কেজির ইলিশের দেখা মিলেছে।

ইউনুস বলেন, ‘রাজধানীসহ দেশব্যপী বিষখালীর ইলিশের প্রচুর চাহিদা, যা আমরা জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছি। ক্রেতারা আগেই জানতে চান, বিষখালীর ইলিশ আছে কিনা।’

বিশখালী নদীতে মাছ ধরেন কালমেঘা এলাকার জেলে আবদুল জলিল। ইঞ্জিনের নৌকা নিয়ে জলিল নদীতে জাল ফেলে ইলিশ ধরেন। তিনি জানান, বরগুনার তিনটি নদীর মধ্যে বিষখালীর ইলিশ খানিকটা গোলাকৃতির ও রুপালি ভাব বেশি থাকায় উজ্জ্বল হয়।

রাজধানীসহ দেশব্যাপী বিষখালীর ইলিশের প্রচুর চাহিদা। ছবি: নিউজবাংলা

পায়রা ও বলেশ্বর বিষখালীর চেয়ে খরস্রোতা, তবে অগভীর। স্রোত বেশি থাকায় পানিতে লবণের মাত্রা বেশি। বিষখালীতে ওই দুটি নদীর চেয়ে স্রোতের তোড় কম থাকায় মিঠাপানি থাকে। এ নদীর গড় গভীরতা ৩০ ফুট। ফলে ইলিশ এখানে দীর্ঘদিন অবস্থান করে ও ঠিকমতো খাবার খেতে পায়। এ কারণে বিষখালীর ইলিশ আকারে হৃষ্টপুষ্ট ও স্বাদ বেশি।

জলিলের কথার সঙ্গে গবেষকদের মতের বেশ মিল।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ইলিশবিষয়ক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিসুর রহমান বলেন, ‘আসলে নদী ভেদে ইলিশের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। স্বাদের পার্থক্যটি হয় পরিবেশ ও খাদ্যের কারণে। মিঠা পানির পরিবেশ এবং খাদ্যের মান ভালো থাকায় বিষখালীর ইলিশ স্বাদে ভিন্ন।’

বিষখালীর ইলিশ দেশের সেরা ইলিশ- এমন দাবি প্রসঙ্গে ড. রহমান জানান, ইলিশ অতিমাত্রায় অভিপ্রায়ানশীল। এরা প্রজনন মৌসুমে নদীতে আসার পর খাদ্য ও পরিবেশ-প্রতিবেশগত আনুকূল্য পেলে সেখানেই অবস্থান নেয়। প্রয়োজনীয় খাদ্য পেলে ইলিশ স্বাদ ও আকারে বেড়ে যায়।

তিনি জানান, ইলিশ প্রধানত প্রাকৃতিক খাদ্যকণা প্ল্যাঙ্কটন খায়। নদীর ধারে চলতে থাকলে ইলিশের খাদ্য গ্রহণ অনেকটাই কমতে থাকে। ইলিশের মাইগ্রেশন সময় শরীরের জমা চর্বির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় শক্তি নিয়ে থাকে।

ইলিশ বিশেষজ্ঞ আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমরা বিষখালীর ইলিশ নিয়ে ভবিষ্যতে আরও গবেষণা চালাব। এ কথা বলা যায় যে, বিষখালী ইলিশের প্রজনন ও বসবাসের জন্য উত্তম।

‘বিষখালী দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঝালকাঠি ও বরগুনা জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। নদীটির দৈর্ঘ্য ১০৫ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৭৬০ মিটার এবং প্রকৃতি সর্পিলাকার। এটি ঝালকাঠি সদরের গাবখান ধানসিঁড়ি ইউনিয়নে সুগন্ধা নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে রাজাপুর, কাঁঠালিয়া ও বেতাগী উপজেলা অতিক্রম করে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার পাথরঘাটা ইউনিয়নের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।’

বাংলাদেশ ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তফা চৌধুরী বিষখালীতে ইলিশের অভয়াশ্রম গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন।ইলিশ বিক্রেতা নাসির মিয়া জানান, আধা কেজি থেকে ৯০০ গ্রাম সাইজের প্রতিকেজি ইলিশ ৬০০ থেকে সাড়ে ৭০০ টাকা। এক কেজি সাইজের ইলিশ ১২০০ টাকা। এরপর প্রতি ১০০ গ্রামে ১০০ টাকা করে বাড়ে। ১৩০০ গ্রাম ওজন হলে ১৩০০ টাকা কেজি, ১৪০০ গ্রামের দাম ১৪০০ টাকা। তবে দেড় কেজি থেকে দুই কেজি পর্যন্ত ইলিশের দাম ১৫০০ টাকা করে কেজি।ওয়ার্ল্ডফিশের ইকো-ফিশ প্রকল্পের দলনেতা আবদুল ওহাব জানান, বিষখালীর ইলিশের সুখ্যাতি দেশজুড়ে। ইলিশের দুই ভান্ডার বঙ্গোপসাগর ও পদ্মা-মেঘনার ইলিশ নিয়ে গবেষণা হয়েছে। বিষখালীর ইলিশ নিয়ে গবেষণা হলে আরেকটি নতুন বৈশিষ্ট্যের ইলিশের ভান্ডারের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।

এ বিভাগের আরো খবর