লকডাউন শেষ হয়ে গেলেও করোনার সময় সংকটে পড়া উত্তরাঞ্চলের হোটেল-রেস্টুরেন্ট ব্যবসার নাজুক হাল এখনও কাটেনি। লাখ লাখ টাকা ভর্তুকি দিয়ে চালানো হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। করোনা পরিস্থিতিতে কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতনও অর্ধেক করা হয়েছে। প্রায় সব রেস্টুরেন্টে অর্ধেক কর্মচারী ছাঁটাই করাও হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ থেকে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ পর্যন্ত ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের কয়েকটি হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
রংপুর, লালমনিরহাট বা পঞ্চগড়ে উল্লেখযোগ্য কোনো হাইওয়ে রেস্টুরেন্ট নেই। তবে উত্তরাঞ্চলের মধ্যে হাইওয়ে রেস্টুরেন্টের জন্য সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল মোড় এলাকা বিখ্যাত। বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে এ এলাকা দিয়ে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলা এবং খুলনা বিভাগের কয়েকটি জেলার দূরপাল্লার বাসসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচল করে।
বঙ্গবন্ধু সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এই সেতুর ওপর দিয়ে ২৪ ঘণ্টায় সাধারণ সময়ে ২৫ হাজারের বেশি যানবাহন চলাচল করে।
উত্তরাঞ্চল বা দক্ষিণের সব গাড়ি যাত্রাবিরতি দেয় সাধারণত হাটিকুমরুল মোড়ের কয়েকটি হোটেল বা রেস্টুরেন্টে। যাত্রীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে সেখানে ‘ভিআইপি’ মানের একাধিক রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। সারা রাত খোলা থাকে হোটেলগুলো। এখানে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার বেচাকেনা হয়। এতে অনেক মানুষের জীবিকার পথও খুলেছে।
তবে জমজমাট ব্যবসা বদলে গেছে বিশ্বকে নাজেহাল করা করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় থেকে। দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর কয়েক দফায় বিধিনিষেধ দেয়া হয় গণপরিবহনের চলাচলে, বন্ধ করা হয় দোকানপাট।
এর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে হাইওয়ে রেস্টুরেন্টগুলোর ওপর। লোকসান এড়াতে ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেয়া হয়। বড় রেস্টুরেন্টে করা হয় কর্মী ছাঁটাই।
প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক-কর্মকর্তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে উত্তরাঞ্চলে ঢাকা-সিরাজগঞ্জ ও ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করে আসছে ফুড ভিলেজ। এসআর গ্রুপের এই প্রতিষ্ঠানের দুটি রেস্টুরেন্ট। একটি বগুড়ার দক্ষিণ সীমানায় ধনকুণ্ডি এলাকায় ১৮ বিঘা জমিতে, যা ২১ বছর আগে গড়ে তোলা হয়। আরেকটি গড়ে উঠেছে প্রায় ৬ বিঘা জমিতে হাটিকুমরুল এলাকায়। চলতি বছর করোনার কারণে প্রায় তিন মাস বন্ধ ছিল রেস্টুরেন্ট। কর্মকর্তারা জানান, এতে তাদের প্রায় দেড় কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
ফুড ভিলেজে প্রায় এক যুগ ধরে চাকরি করছেন আশরাফুল ইসলাম সেলিম। তিনি বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক। নিউজবাংলাকে আশরাফুল বলেন, ‘করোনার প্রভাব দেখা দেয়ার পর থেকেই দেশের সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধুঁকে ধুঁকে চলছে। দেশে বিভিন্ন সময় সরকারি বিধিনিষেধ আরোপের পর রেস্টুরেন্ট কার্যত বন্ধ রাখতে হয়েছে। তারপরও কিছু খরচ ঠিকই হয়েছে।
‘তবে মালিকপক্ষ প্রথম থেকেই অর্ধেক শ্রমিক রেস্টুরেন্টে রেখেছে। শিফট করে কাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর মধ্যে অবশ্য অনেকে পেশা বদল করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘লোকসান কমাতে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বেতনও অর্ধেকে নামিয়েছে। কারণ প্রতি মাসে এই রেস্টুরেন্টে অন্তত অর্ধকোটি টাকা শ্রমিকদের বেতন দিতে হতো। লকডাউন তুলে দেয়ার পরও পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। কারণ সাধারণ মানুষ আগের মতো করে এখনও রাস্তায় বের হয়নি। হলেও রেস্টুরেন্টমুখী কম। এ কারণে ব্যবসা নেই বললেই চলে। আশা করা হচ্ছে কোনো সমস্যা না থাকলে আগামী তিন মাসের মধ্যে আগের অবস্থায় ফেরা সম্ভব হবে।’
একই এলাকার ওভি হাইওয়ে ভিলা করোনার পর চালুই হয়নি। এই প্রতিষ্ঠানে করোনার আগে ৪০০ শ্রমিক ছিল। এখন কমিয়ে অর্ধেক করা হয়েছে। তবে রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকার কারণে কোনো শ্রমিকের বেতন হয় না।
এই রেস্টুরেন্টের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘করোনার কারণে রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখা হয়েছে। শ্রমিকদের কাজ নেই, বেতনও দেয়া হয়নি। অনেকে ক্ষোভে চাকরি ছেড়েছেন। সরকারের তরফ থেকে একাধিকবার তালিকা নেয়া হলেও কোনো সহায়তা পাওয়া যায়নি।’
এ বিষয়ে ওভি হাইওয়ে ভিলা রেস্টুরেন্টের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক হাফিজুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার কারণে দেশের সব রেস্টুরেন্টের ব্যবসার অবস্থা খারাপ। সবাইকে বিভিন্ন সংকট মেনে কাজ করতে হচ্ছে।’
লকডাউনে শ্রমিকদের বেতন বন্ধের কথা স্বীকার করলেও এ নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি এই কর্মকর্তা।
মহাসড়কের হাটিকুমরুল এলাকায় ২০ বছরের বেশি সময় ধরে আছে অ্যারিস্টোক্র্যাট নামের রেস্টুরেন্টটি। এখানে ১০০ শ্রমিক-কর্মকর্তা কাজ করেন। করোনার সময় এই প্রতিষ্ঠানের কাউকে ছাঁটাই করা না হলেও বেতন কমানো হয়েছে। তবে চলতি মাস থেকে শ্রমিকদের বেতন আবার স্বাভাবিক করা হয়েছে।
অ্যারিস্ট্রোক্র্যাটের ব্যবস্থাপক শেখ গোলাম রহমান বলেন, ‘চাকরি জীবনে এমন পরিস্থিতির মুখে কখনও পড়তে হয়নি। ১২ বছর চাকরি করা অবস্থায় কাস্টমারের এত সংকট কখনও দেখা দেয়নি।
‘এখন রেস্টুরেন্ট চালালে কোনো মতে খরচের টাকা উঠছে। তবে মালিকের কোনো লাভ হচ্ছে না। করোনা চললে আদৌ লাভের মুখ দেখা যাবে কি না, তাও বলা যাচ্ছে না।’
বগুড়ার শাজাহানপুরে ছোট পরিসরে গড়ে ওঠা জব্বার হোটেল কম সময়েই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। করোনায় তাদের অবস্থায়ও নাজুক। এই প্রতিষ্ঠানের ৫০ শ্রমিককে ছাঁটাই করা না হলেও রেস্টুরেন্ট বন্ধের সময় কাউকে বেতন দেয়া হয়নি।
এই রেস্টুরেন্টের অন্যতম মালিক শাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘করোনায় সবাই মিলে বাঁচার চেষ্টা করা হচ্ছে। মহামারির ওপর তো কারও হাত নেই।’
গাইবান্ধার অন্যতম বন্দর গোবিন্দগঞ্জ। বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের ওপর এখানে মায়ামনি রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে কয়েক বছর হলো। পঞ্চগড়-নীলফামারী থেকে আসা কিছু পরিবহন এখানে যাত্রাবিরতি দেয়।
এই প্রতিষ্ঠানের মালিক বাবুল লাল চৌধুরী বলেন, ‘উত্তরাঞ্চলে ভালোমানের হাইওয়ে রেস্টুরেন্ট বিবেচনা করা হলে, সেগুলো হাটিকুমরুলে গড়ে ঊঠেছে। করোনায় তাদের মতোই আমাদের অবস্থা। লকডাউনের পর রেস্টুরেন্ট খোলা থাকলেও বিক্রি নেই। অথচ মাসে শ্রমিকদের সাড়ে চার লাখ টাকা বেতন দিতে হয়। সরকারি কোনো অনুদানও মিলছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে পথে বসা ছাড়া উপায় থাকবে না।’
উত্তরাঞ্চলের রেস্টুরেন্ট মালিকদের কোনো সংগঠন নেই। তবে বগুড়ায় আছে হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। এর সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান নিশাদ বলেন, ‘করোনাকালে এই খাতে কোটি কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। অনেকে ব্যবসা বন্ধ করেছে। মহামারি করোনার সময় সব দিক বিবেচনা করা দরকার।
‘মালিকরা লোকসানে নাজেহাল হওয়ার পর টিকে থাকার জন্য শ্রমিকদের ছাঁটাই করেছেন। এখন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে খোঁজ নিয়ে এসব শ্রমিকদের জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে।’