বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মদের লাইসেন্সে কালব-এর ৭ কোটি টাকা ‘হাওয়া’

  •    
  • ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০৮:১৮

মদ বিক্রির লাইসেন্সের জন্য ৭ কোটি টাকা খরচের অনুমোদন দিয়েছে কালব-এর পরিচালনা পর্ষদ। এরই মধ্যে পুরো অর্থ নাম সর্বস্ব মধ্যস্ততাকারী প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কালব-এর দুই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অভিযোগ করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনে। 

শিক্ষকদের ঋণ দিয়ে স্বাবলম্বী করার উদ্দেশ্যে ১৯৭৯ সালে যাত্রা শুরু করে দ্য কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন অফ বাংলাদেশ বা কালব। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে বেশ কয়েক বছর স্বাভাবিকভাবে চললেও পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে দুর্নীতির অভিযোগ। অর্থ তছরুপ, বিতর্কিত খাতে বিনিয়োগসহ নানা অনিয়মে বিপর্যস্ত সমবায় প্রতিষ্ঠানটি।

বেশ পুরোনো সমবায় প্রতিষ্ঠান কালবে রাখা সাধারণ আমানতকারীদের অর্থ লোপাটের অভিযোগও উঠেছে। নতুন খাত তৈরি করে প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে নেয়া হচ্ছে অর্থ। দিনের পর দিন এমন ঘটনা ঘটলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।

সম্প্রতি মদ বিক্রির লাইসেন্স করা নিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছে কালব। লাইসেন্সের জন্য সাত কোটি টাকা খরচের অনুমোদন দিয়েছে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ। এরই মধ্যে পুরো অর্থ নাম সর্বস্ব মধ্যস্ততাকারী প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কালব-এরই দুই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ করেছেন।

এর আগে নিয়ম ভেঙে কয়েক কোটি টাকার চাল কিনে মজুত করে লোকসানের মুখে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া, গাড়ি কিনতে পরিচালকদের নামমাত্র সুদে ঋণ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এর আগের পরিচালনা পর্ষদের সময়ে ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে।

মদের লাইসেন্স পেতে সাত কোটি টাকা

সংশ্লিষ্টরা জানান, ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করে গাজীপুরে রিসোর্ট তৈরি করেছে সমবায় প্রতিষ্ঠান কালব। প্রথমে ‘কালব রিসোর্ট অ্যান্ড কনভেনশন হল’ নাম দেয়া হলেও পরে তা পরিবর্তন করে নাম রাখা হয় ‘কালব রিসোর্ট রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বার’।

এই বারে মদ বিক্রির লাইসেন্স পেতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ‘এন সরকার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’ নামের একটি কনসালট্যান্ট ফার্মের সঙ্গে সাত কোটি টাকার চুক্তি করে কালব।

১০০ টাকার স্ট্যাম্পে এই চুক্তি করার সময়েই পরিশোধ করা হয় ৫০ ভাগ অর্থ। শর্ত অনুযায়ী, অর্ধেক কাজ শেষ হলে আরও ২৫ ভাগ অর্থ দেয়ার কথা। তবে কোন কোন খাতে এই অর্থ ব্যয় হবে তা স্পষ্ট করা হয়নি চুক্তিতে। চুক্তি অনুযায়ী ফি বাবদ প্রতিষ্ঠানটি নেবে আরও ১১ লাখ টাকা।

কালব-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সমিতির সদস্য এ্যানথনী ম্যানসাং দাবি করেছেন, লাইসেন্সের ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি না থাকলেও পুরো সাত কোটি টাকা অ্যাকাউন্ট থেকে তোলা হয়েছে।

কালব-এর এক সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাম প্রকাশ না করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) পাস করে নিতে হয়। মদের লাইসেন্স করতে সাত কোটি টাকা ব্যয়ের সিদ্ধান্ত পরিচালনা পর্ষদের পাস হয়েছে; তবে এজিএমে হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘ক্রেডিট ইউনিয়নের নীতিমালা অনুযায়ী, পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও সমাজের ক্ষতি করে এমন কোনো বিনিয়োগ করা যাবে না।

‘যে রিসোর্টের নামে বারের লাইসেন্স করতে চাইছে ওটার নাম ছিল কালব রিসোর্ট অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, মদ বিক্রির জন্য সেটার নাম বদলে দিয়েছেন বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান জোনাস ঢাকী ও সাধারণ সম্পাদক আলফ্রেড রায়সহ তিন সদস্য।’

খাত স্পষ্ট না করে টাকা তুলে নিয়ে পরিচালনা পর্ষদের কয়েক সদস্য নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করেছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

লাইসেন্স পাইয়ে দিতে চুক্তি করা ‘এন সরকার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’ রাজধানীর পুরানা পল্টনের যে ঠিকানা দিয়েছে, সেখানে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ৫৫/এ, এইচ এম সিদ্দিক ম্যানশন ঠিকানায় যাওয়ার পর সেখানকার লোকজন জানান, ওই নামে কোনো প্রতিষ্ঠান কখনওই ছিল না।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে এন সরকার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের আয়কর আইনজীবী ও পরামর্শক নিতিশ সরকারকে একাধিকার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

মদের লাইসেন্স ফি কত?

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মদের লাইসেন্স নেয়ার জন্য সরাসরি মহাপরিচালক বরাবর আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের প্যাডে আবেদন করতে হয়। আবেদনপত্রের সঙ্গে ১৩ ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে হয়। এসব যাচাই-বাছাই করে মন্ত্রণালয় থেকে এনওসি (নো অবজেকশন লেটার) আসার পর চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। এর জন্য অন্য কোনো পক্ষের সঙ্গে চুক্তির দরকার নেই।

লাইসেন্স পেতে সরকার নির্ধারিত ফি এক লাখ টাকার সঙ্গে ১৫ হাজার টাকা ভ্যাট দিতে হয়। সাধারণত পর্যটন শিল্পে উৎসাহ দিতে এ ধরনের লাইসেন্স অনুমোদন দেয়া হয়ে থাকে।

কালব-এর নানা অনিয়ম নিয়ে দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছে। ফাইল ছবি/নিউজবাংলা

দুদকে অভিযোগ

কালব-এর নানা অনিয়ম তুলে ধরে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দিয়েছেন দি খ্রীস্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়নের সদস্য (কালবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সমিতি) এ্যানথনি ম্যানসাং।

তিনি বলেন, ‘মদের লাইসেন্স পেতে সাত কোটি টাকার চুক্তি কেন? কৌশলে এই অর্থ সমবায় থেকে বের করে নেয়া হচ্ছে।’

দুদকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ‘সমবায় আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী যেকোনো বিনিয়োগের আগে সাধারণ সভা ও সমবায় অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হবে। বর্তমান চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারি অনুমতি না নিয়ে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা, সমবায় অধিদপ্তর প্রতি বছর নিরীক্ষা করলেও অদৃশ্য কারণে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।’

কালব-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সমিতি তুমিলিয়া খ্রীস্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়নের সদস্য অনিল ডি. কস্তাও আলাদা অভিযোগ জমা দিয়েছেন দুদকে।

তিনি বলেন, ‘বারের লাইসেন্সের জন্য কৌশলে প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। কোনো প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে মদের বার করা যায় না। বাংলাদেশে এমন কোনো নজির নেই। অর্থ আত্মসাতের জন্য চেয়ারম্যান, সেক্রেটারি ও এক পরিচালক এটা করেছেন। এই তিনজন বারের লাইসেন্সের জন্য কাজ করছেন। অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে বোর্ডের অন্য সদস্যরা জানেন না।

তিনি দাবি করেন, ‘এমনকি বার লাইসেন্সের জন্য চূড়ান্ত খরচ বোর্ডে অনুমোদন করা হয়নি। বোর্ডে অর্থ ব্যয়ের আলোচনা না করে পরে রেজুলেশনে মিথ্যা কথা লিখেছেন। অথচ বোর্ডের বাকি ৯ সদস্য এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।’

চাল ব্যবসায় বড় লোকসান

কালব-এর পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে বেশি দামে চাল কিনে বিপুল লোকসান গোনার অভিযোগও রয়েছে। এতে বলা হয়, চাল কিনে মজুত করতে কালবের চেয়ারম্যান জোনাস ঢাকীকে আহ্বায়ক, পরিচালক একরামুল হককে সদস্য সচিব এবং বাবলু কোড়াইয়াকে সদস্য করে কমিটি করা হয়।

কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী দিনাজপুরে চাল কিনে গুদামজাত করার জন্য ৫ কোটি টাকা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় পাস হয়। কমিটি চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩ লাখ ৯০ হাজার কেজি চিনিগুঁড়া চাল কিনে দিনাজপুর শহরের পুলেরহাটে গুদাম ভাড়া করে মজুত করে। প্রতি কেজি চাল কেনা হয় ৭৭ টাকা, পরিবহন বাবদ ২ টাকা খরচ ধরে দাম দাঁড়ায় ৭৯ টাকা।

অথচ একই সময় দিনাজপুরের মিলগুলোতে রপ্তানির চিনিগুঁড়া চালের পাইকারি দর ছিল ৭৫ টাকা কেজি। সেখানে কেজিতে অন্তত ২ টাকা বেশিতে চাল কিনেছে কালব।

অভিযোগ করে বলা হয়, তিন মাসের বেশি সময় চিনিগুঁড়া চাল মজুত করলে গুণগত মান নষ্ট হতে থাকে। অথচ কালব সাত মাস ধরে চাল মজুত করে রেখেছে। বাজার দরের চেয়ে বেশি হওয়ায় এবং দীর্ঘদিন মজুত করায় এখন ৭৯ টাকা কেজি দরের চালের দাম উঠছে সর্বোচ্চ ৬০ টাকা।

৭৯ টাকা দরে ৩ লাখ ৯০ কেজি চালের দাম ৩ কোটি ৮ লাখ ১০ হাজার টাকা। বিনিয়োগ টাকার সঙ্গে ১২ শতাংশ হারে ৭ মাসের সুদ ২১ লাখ ৬৬ হাজার ৭০০ টাকা যুক্ত হলে মূল্য দাঁড়াবে ৩ কোটি ২৯ লাখ ৬৬ হাজার ৭০০ টাকা।

এখন ৬০ টাকা দরে চাল বিক্রি করলে ২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা আসবে কালবের। এতে নিট লোকসান হবে ৯৫ লাখ ৬৬ হাজার ৭০০ টাকা।

তছরুপ প্রায় ২০০ কোটি টাকা

এর আগে ২০১৯ সালে কালব-এর তখনকার চেয়ারম্যান সায়মন এ. পেরেরাসহ কয়েক জনের বিরুদ্ধে ভুয়া কোম্পানি খুলে ৭৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া ওই কমিটি আরও ১০০ কোটি টাকা তছরুপ করে বলে তদন্তে প্রমাণ পায় পুলিশের বিশেষায়িত তদন্ত বিভাগ পিবিআই।

এ ঘটনায় দুদক মামলা করার পর সাইমন এ. পেরেরা যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক রতন এফ কস্তা এখন কারাগারে আছেন। মামলার অন্য আসামিরা পলাতক।

অভিযোগ ‘বিস্ময়কর’, বক্তব্য নেই অভিযুক্তদের

সমবায় বিশ্লেষক ও দি খ্রিষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেডের প্রেসিডেন্ট পঙ্কজ গিলবার্ট কস্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সমবায় প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা হবে দৃষ্টান্তমূলক। সবার জন্য তা হবে উদাহরণ। মদ বিক্রি করা হলে সেই ঐতিহ্য থাকবে না। মদ সাধারণত ফাইভ স্টার হোটেলে রাখা হয়, কারণ সেখানে বিদেশিরা আসেন।’

তিনি বলেন, ‘একটি লাইসেন্স নেবার জন্য সাত কোটি টাকা ব্যয়ের তথ্য বিস্ময়কর। মদের লাইসেন্স ফি অনেক কম।’

আমানতকারীদের অর্থ এভাবে ব্যয় নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন।

সমবায় অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শুধু মদের লাইসেন্স নয়, কালব-এর সার্বিক অনিয়ম খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিষয়টি তদন্ত করা হবে।’

দুদকে অভিযোগের বিষয়ে কালব-এর চেয়ারম্যান জোনাস ঢাকীর বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুদকের কাজটা কী? কিসের বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান করে? এ ব্যাপারে আমি আপনাকে এমন কিছুই বলতে চাই না। কোনো স্টেটমেন্ট দেবো না।’

এ বিভাগের আরো খবর