বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রইল বাকি দুই

  •    
  • ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ২২:২৪

করোনার মহামারিতে প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর খুলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর পরই প্রকাশ পাওয়া শুরু করেছে কুড়িগ্রামে বাল্যবিবাহের ভয়াবহ চিত্র।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের সারডোব উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ছাত্রী ছিল ৯ জন। করোনা মহামারিতে বিদ্যালয় বন্ধের সময় তাদের মধ্যে একজন ছাড়া বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে সব ছাত্রী। একই অবস্থা দশম শ্রেণিতে। চার ছাত্রীর মধ্যে তিনজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে।

বাদ যায়নি ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীরাও। ষষ্ঠ শ্রেণিতে একজন, সপ্তম শ্রেণিতে দুজন এবং অষ্টম শ্রেণির চারজনকে গোপনে বিয়ে দিয়েছে পরিবার।

করোনার মহামারিতে প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর খুলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর পরই প্রকাশ পাওয়া শুরু করেছে কুড়িগ্রামে বাল্যবিবাহের ভয়াবহ চিত্র।

সারডোব উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নার্গিস নাহার জানায়, ১২ সেপ্টেম্বর সারা দেশের স্কুল খোলার পর খুশিমনে বিদ্যালয়ে যায় সে। তবে শ্রেণিকক্ষে ঢোকার পর তো তার চক্ষু চড়কগাছ। কোনো বান্ধবীই ক্লাসে আসেনি। পরে জানতে পারে করোনায় বন্ধের সময় সব বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গেছে।

সে আরও জানায়, তার বান্ধবীদের মধ্যে নুরবানু, নাজমা, স্বপ্না, হেলেনা, চম্পা, লুৎফা, চাঁদনী ও আরফিনার বিয়ে হয়ে গেছে। তার স্বপ্ন পড়াশোনা করে স্বাবলম্বী হওয়া। এমন পরিস্থিতিতে আদৌ সে স্বপ্ন পূরণ হবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা তার।

নার্গিস বলে, ‘গত দেড় বছরে আমার আট বান্ধবীর বিয়ে হয়েছে। এখন শুধু আমিই বাকি রয়েছি। স্কুল খোলার পর বান্ধবীদের বিয়ের কথা জানতে পারি। আমি আমার বাবা-মাকে বলেছি সেই কথা। তাদের এও বলেছি, আমার পড়াশোনা শেষ করে একটি চাকরি করে নিজের অবস্থা তৈরি করেই বিয়ে করব। এর আগে নয়।’

সে আরও বলে, ‘বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় এখন আমি একা। ক্লাসে এলেই মন খারাপ হয়ে যায়। কারও সঙ্গে কোনো কিছু শেয়ার করতে পারি না। তাই মন খারাপ করেই ক্লাস করতে হচ্ছে।’

একই অবস্থা বিদ্যালয়টির দশম শ্রেণিতে। ওই শ্রেণির চার ছাত্রীর মধ্যে জেসমিন নামে একজন ছাড়া বাকি তিনজনই বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে।

আইন ভেঙে মেয়েদের বিয়ে দিলেও অবশ্য অভিভাবকদের দাবি, তারা ঠিক কাজই করেছেন। কারণ মেয়েদের বয়স যত বাড়ে তাদের জন্য যৌতুক তত বেশি দিতে হয়। স্বর্ণালংকারও দিতে হয়।

সদর উপজেলার নাজিম আলী বলেন, ‘আমাদের সরকার কী কবাইছে জানে ২১, ২২, ১৮, ১৯ বছর হলে কে নিবে মেয়েকে? কেউ নিবের নয়। মেয়ে যত বড় হবে দু, আড়াই, তিন, পাঁচ লাখ ডিমান্ড (যৌতুক) হবে।

‘মেয়ের একটু বয়স হলেই কয় এক লাখে হবার নয়; হাত-পায়ের সোনা দেয়া নাগবে।’

একই এলাকার বুলবুলি বেগম বলেন, ‘তাড়াতাড়ি বিয়ে দেই হামরা গরিব মানুষ। মেয়ে ছইল যত বড় হইব তত ডিমান্ড হার বাড়ব। মেয়ে যদি ম্যাট্রিক পাস করাই তাইলে ছেলে নেয়া লাগব ইন্টার পাস। সেই সামর্থ্য যদি হামরা করবার না পারি, সে জন্য ছোটতে মেয়ের বিয়ে দেই।’

আহাম্মদ আলী নামে একজন জানান, এসব বাল্যবিবাহ সাধারণত এলাকায় হয় না। মেয়েপক্ষ আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে গোপনে বিয়ে দেয়। কেউ এক ইউনিয়ন থেকে অন্য ইউনিয়ন, আবার কেউ এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় নিয়ে বিয়ে দেন। বিয়ের কথা সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ না করে ১৫ দিন অথবা এক মাস পর প্রকাশ করেন বাবা-মা।

সারডোব বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুল মজিদ চৌধুরী বলেন, ‘নবম শ্রেণিতে ৩৬ জন ছাত্রছাত্রী। এর মধ্যে ৯ জন ছাত্রী আর ২৭ জন ছাত্র। স্কুল খোলার পর বাল্যবিবাহের বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে, যা খুবই দুঃখজনক। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি মেয়েদের পড়ালেখামুখী করতে।’

প্রধান শিক্ষক ফজলে রহমান বলেন, ‘আমার বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ২২৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৩ জন ছাত্রী। তাদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ মেয়ে এবং ৭০ শতাংশ ছাত্র বিদ্যালয়ে উপস্থিত হচ্ছে। বাকিদের খোঁজখবর নিতে শিক্ষকদের নিয়ে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিদ্যালয়ে না আসার প্রকৃত কারণ বের করবেন।’

একই এলাকার উত্তর হলোখানা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুল রাজ্জাক জানান, তার বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৪২ ছাত্রীর মধ্যে দুজন, সপ্তম শ্রেণিতে ৪৫ ছাত্রীর মধ্যে দুজন এবং অষ্টম শ্রেণিতে ৩৩ ছাত্রীর মধ্যে পাঁচজন বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে।

জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শামসুল আলম বলেন, ‘আমরা সদরের পাঁচটি স্কুল পর্যবেক্ষণ করেছি। এই স্কুলগুলোতে ৬৩ জন মেয়েশিশু বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্যে দেখা যায়, শতকরা ১৩ ভাগ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।

‘ঝরে পড়া কন্যাশিশুদের অধিকাংশই বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। এ হিসাবে জেলায় গত দেড় বছরে ঝরে পড়া শিশুশিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার।’

তিনি জানান, জেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ঝরে পড়া ও বাল্যবিবাহের শিকার ছাত্রীদের প্রকৃত তথ্য নিতে উপজেলাগুলোতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহে জেলার প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে। তথ্য পাওয়ার পর জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সভায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে করণীয় ঠিক করা হবে।

বেসরকারি সংস্থা প্লান বাংলাদেশের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত জেলায় মোট বিয়ে হয়েছে ২২ হাজার ৩৯১টি। এর মধ্যে নিবন্ধিত বিয়ে ১৯ হাজার ২২১টি এবং অনিবন্ধিত ৩ হাজার ১৭০টি।

এর মধ্যে জেলার ৯ উপজেলায় বাল্যবিবাহ হয়েছে ৩ হাজার ১৯টি। এর মধ্যে কুড়িগ্রাম সদরে ৭৩০টি, রাজারহাটে ৭৪, উলিপুরে ২৬১, চিলমারীতে ১৪৬, রৌমারীতে ৮৮, রাজিবপুরে ৫০, নাগেশ্বরীতে ১ হাজার ১৪০, ফুলবাড়ীতে ২৯১, ভূরুঙ্গামারীতে ২৩৯টি বাল্যবিবাহ হয়েছে।

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ হয়েছে ১ হাজার ১৩৬টি।

এ বিভাগের আরো খবর