মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার ৪ নম্বর বামন্দী ইউনিয়নে বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ডের জন্য টাকা তোলার অভিযোগ উঠেছে ইউপি চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে।
ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড নিশিপুর গ্রামের ৯৫ জনের কাছ থেকে ২৫০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত তোলার কথা জানিয়েছেন ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যও।
অভিযোগ অস্বীকার করে ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম বিশ্বাস দাবি করেন, বয়স্ক ও বিধবা ভাতার কার্ডের জন্য অর্থ আদায়ের বিষয়টি তার জানা নেই। এমন ঘটনা ঘটলে অভিযুক্তদের আইনের মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হবে।
ভুক্তভোগীরা জানান, বয়স্ক ও বিধবা ভাতার কার্ডের জন্য আবেদনের তারিখ ছিল কিছুদিন আগে। পরে তালিকাভুক্তদের নাম যাচাই-বাছায়ের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দায়িত্ব দেয়া হয় গ্রাম পুলিশকে।
তাদের অভিযোগ, নিশিপুর ওয়ার্ডের গ্রাম পুলিশ সদস্য জাহিদুল ইসলাম নাম যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব পান। তবে তার সঙ্গে চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ ও স্থানীয় নেতা দেলোয়ার হোসেন ওই গ্রামের এনামুল হককে পাঠান।
এনামুল ভাতার কার্ডের জন্য জনপ্রতি ২৫০ টাকা থেকে শুরু করে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করেন। টাকা না দিলে তালিকা থেকে নাম কেটে দেয়ার হুমকি দেন তিনি। বাধ্য হয়ে তারা টাকা দিয়েছেন।
বিধবা রোকেয়া খাতুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার স্বামী অনেক দিন আগে মারা গিছে। আমি দুই মেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে সংসার চালাই। আমাকে বিধবা কার্ড কইরি দেবে বইলি আমার কাছ থাইকি ২৫০ টাকা নিগিছে গ্রাম পুলিশ জাহিদুল ও চেয়ারম্যানের কাছের লোক এনামুল।’
রেজিয়া খাতুন নামে আরেকজন বলেন, ‘আমার প্রতিবন্ধী স্বামীকে কার্ড করে দেয়ার নাম করে এনামুল তিন হাজার টাকা দাবি করে। আমি টাকা দিতে পারব না বুললে সে বলে এখন তাহলে কিছুই হবে না। পরে আমি এনামুলকে এক হাজার টাকা দিই।
‘তার কিছুদিন পর আমাকে আইডি কার্ড নিয়ে গাংনীতে যাইতে বুললে আমি কার্ড নিয়ে গাংনী যাই। সেখান থাইকি আরও ৫০০ টেকা আমার কাছ থেকে আদায় করে।’
ভাতার কার্ডের জন্য টাকা নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যের মৃত্যুতে ওই দায়িত্ব পাওয়া শাহনেওয়াজ লাল্টু।
তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে আমার ওয়ার্ডের বয়স্ক, বিধবা কার্ড করে দেয়ার নাম করে ৯৫ জনের কাছ থেকে টাকা আদায় করেছে গ্রাম পুলিশ ও স্থানীয় এনামুল হক।
‘এ দুজন মিলে গ্রামের কারোর কাছ থেকে ২৫০-৫০০ টাকা, এমনকি প্রতিবন্ধী কার্ড করার জন্য ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত নিছে। আমি বিষয়টি শুরুতে জানতে না পারলেও যখন জানতে পেরেছি, তখন বিষয়টি সাংবাদিকদের জানিয়েছি।’
লাল্টু জানান, স্থানীয়দের সহযোগিতায় এনামুলের কাছ থেকে চার হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের সহকারী সচিবের মাধ্যমে তা জমা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া যাদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়েছে, তাদের টাকা ফেরত দেয়ার জন্য বলা হয়েছে।
নিশিপুরের বাসিন্দা ইউনুস আলী অভিযোগ করেন, চেয়ারম্যানের অত্যন্ত কাছের কিছু মানুষ আছে, যাদের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে এমন অর্থ-বাণিজ্য চালাচ্ছেন তিনি। তাদের মধ্যে অন্যতম দেলোয়ার হোসেন। তার নির্দেশে গ্রাম পুলিশ ও এনামুল এই টাকা তুলে ভাগ করে নিয়েছেন।
এ বিষয়ে এনামুল বলেন, ‘আমি তাদের জন্য কষ্ট করেছি। তারা পারিশ্রমিক হিসেবে এই টাকা আমাকে দিয়েছেন। আমি কিছু টাকা খরচ কইরি ফেইলিছি আর কিছু ফেরত দিয়ে দিছি।
‘একটি প্রতিবন্ধী কার্ড করার জন্য উপজেলা সমাজসেবা অফিসে গিয়েছি। ডাক্তারের সার্টিফিকেট নেয়ার জন্য মেহেরপুরে হাসপাতালে গিয়েছি। এতে আমার খরচ হয়েছে, তাই আমি এই টাকা নিয়েছি।’
দেলোয়ার হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ইউনিয়ন পরিষদের কেউ না। আর আমি কাউকে টাকা নিতেও বলিনি।’
গ্রাম পুলিশ (চৌকিদার) জাহিদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি বয়স্ক ও বিধবার নামের তালিকা ধরে তাদের বাড়িতে বাড়িতে যাই। এ সময় চেয়ারম্যান সাহেবের খুব কাছের লোক দেলোয়ার হোসেন জোর করে আমার কাছ থেকে নামের লিস্ট কেড়ে নেয় এবং আমার সাথে এনামুল হক হিন্দিকে পাঠায়। আমি কারোর কাছ থেকে এক টাকাও হাতে ধরিনি। আমি চলে আসার পর এগুলো করেছে এনামুল হক হিন্দি।’
তিনি আরও বলেন, ‘তা ছাড়া চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে আগেই বলে দিয়েছিল ১ নম্বর ওয়ার্ডে কোনো কিছু করলে যেন দেলোয়ারকে জানাই। সামান্য চৌকিদার আমার এত বড় ক্ষমতা নাই, চেয়ারম্যান সাহেবের নির্দেশের বাইরে যাই।’
৪ নম্বর বামন্দী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম বিশ্বাস বলেন, ‘দেলোয়ার ইউনিয়ন পরিষদের কেউ না। তবে ও গ্রামের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাই মাঝেমধ্যে গ্রাম্য সালিশ হলে বা বিভিন্ন কাজ নিয়ে পরিষদে আসে। তবে বয়স্ক ও বিধবা কার্ডসংক্রান্ত বিষয়ে কেউ কোনো টাকা নিয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
গাংনী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মৌসুমী খানম জানান, ‘বিষয়টি মৌখিকভাবে শোনার পর লিখিত অভিযোগ দিতে বলেছি। তারা লিখিত অভিযোগও করেছে। আমি তদন্ত করে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেব।’