বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘৭৫ কোটি টাকার’ সাপের বিষ পরীক্ষায় মূল্যহীন তরল

  •    
  • ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৯:৫৯

তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, এই প্রতারকদের ফাঁদে সাধারণ মানুষ যেমন পা দেয়, একইভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের ফাঁদে পা দিয়ে সাপের বিষ মনে করে তাদের গ্রেপ্তার করে।

সাপের বিষ বিক্রির অভিযোগে ছয়জনের একটি চক্রকে গ্রেপ্তারের ৯ মাস পর বিস্ময়কর তথ্য জানিয়েছে পুলিশ। বাহিনীটি বলছে, র‌্যাবের অভিযানের সময় তাদের কাছ থেকে জব্দ করা জার পরীক্ষাগারে পাঠিয়ে তাতে সাপের বিষের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সাধারণ তরল পদার্থকে সাপের ভুয়া বিষ বলে মানুষের টাকা হাতিয়ে নিত চক্রটি।

গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর দক্ষিণখানের গুলবার মুন্সি সরণি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ওই চক্রের ছয় সদস্যকে আটক করে র‌্যাব-২-এর একটি দল। তখন র‌্যাব থেকে জানানো হয়, তাদের কাছ থেকে সাপের বিষের ছয়টি জার জব্দ করা হয়। এসব জারে থাকা বিষের মূল্য প্রায় ৭৫ কোটি টাকা।

এমনকি র‌্যাব জানায়, আটককৃতরা একটি সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক সাপের বিষ চোরাচালান চক্রের সক্রিয় সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে দক্ষিণখান থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করা হয়।

তবে মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে সাপের বিষের অস্তিত্ব পায়নি পুলিশ। আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে ছয়টি জারের সাপের বিষ আছে কি না, তা ল্যাবে পরীক্ষা করায় দক্ষিণখান থানার পুলিশ। ল্যাব পরীক্ষার রিপোর্টে বলা হয়েছে, এসব জারে কোনো বিষ নেই।

র‌্যাবের অভিযানে উদ্ধার ছয়টি জারে সাপের বিষের অস্তিত্ব না পাওয়ায় গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে মামলার ধারায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষ ক্ষমতা আইনের ধারা বাদ দিয়ে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ ও প্রতারণার ধারায় (৪০৬/৪২০) অভিযুক্ত করা হয়েছে তাদের।

মামলার ধারার পরিবর্তনের যুক্তিও দেখিয়েছে দক্ষিণখান থানার পুলিশ। তারা বলছে, কোটি কোটি টাকা মূল্যের সাপের বিষের কথা বলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল এই চক্রের সদস্যরা। প্রতারণার উদ্দেশ্যেই কাচের জারের থাকা তরল পদার্থকে কোবরা সাপের বিষয় বলে প্রচার করছিল তারা।

তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, এই প্রতারকদের ফাঁদে সাধারণ মানুষ যেমন পা দেয়, একইভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের ফাঁদে পা দিয়ে সাপের বিষ মনে করে তাদের গ্রেপ্তার করে।

কয়েকজন আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্রের সদস্য বিপুল পরিমাণ সাপের বিষ নিয়ে চোরাচালানের উদ্দেশ্যে অবস্থান করছে, এমন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়েছিল র‌্যাবের দলটি। ঘটনাস্থল থেকে মাসুদ রানা, ছফির উদ্দিন শানু, তমজিদুল ইসলাম অরফে মনির, আলমগীর হোসেন, ফিরোজা বেগম ও আসমা বেগমকে আটক করা হয়।

পরে র‌্যাব জানায়, তাদের সঙ্গে থাকা ব্যাগ তল্লাশি করে কাচের জারে রাখা সাপের বিষ পাওয়া গেছে, যার আনুমানিক মূল্য ৭৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া তাদের কাছ থেকে সাপের বিষসংক্রান্ত সিডি ও সাপের বিষের ম্যানুয়াল বইও উদ্ধার করা হয়।

আটক ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে র‌্যাব জানিয়েছিল, একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর কাছে সাপের বিষের ব্যাপক চাহিদা থাকায় অধিক মুনাফার লোভে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাপের বিষ সংগ্রহ করে চোরাচালান করে আসছিল আটককৃতরা। তারা একটি সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক সাপের বিষ চোরাচালান চক্রের সক্রিয় সদস্য।

ছয়জনকে সাপের বিষসহ আটকের পর তাদের বিরুদ্ধে গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর দক্ষিণখান থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে র‌্যাব, যার তদন্ত কর্মকর্তা দক্ষিণখান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সাইফুল ইসলাম।

তদন্তের শুরুতেই উদ্ধার হওয়া বিষ ল্যাবে পরীক্ষার জন্য আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে উদ্ধার হওয়া জারে বিষ আছে কি না, তা জানতে জারগুলো রাজশাহীর ল্যাবে পাঠানো হয়। পরীক্ষা শেষে ল্যাব থেকে জানানো হয়, ‘কাচের জারে সাপের বিষের কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি।’

এসআই সাইফুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাপের বিষ কোটি কোটি টাকা দাম। এটা থেকে ওষুধ তৈরি করা হয়। এসব বিষয়কে পুঁজি করে গ্রেপ্তার ছয়জনসহ অন্যরা প্রতারণার ফাঁদ পাতে। লোভে পড়ে সাধারণ মানুষ তাদের ফাঁদে পা দেয়। সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করার জন্য কাচের জারে তরল পদার্থ রেখে বলে বেড়াত কোটি টাকা মূল্যের সাপের বিষ রয়েছে। পুরো বিষয়টাই প্রতারণা। আমরা ল্যাব টেস্টে সাপের বিষের কোনো অস্তিত্ব পাইনি।’

অভিযানের পর ন্যূনতম যাচাই না করে গণমাধ্যমে কোটি কোটি টাকার অঙ্ক না বলাই শ্রেয় বলে জানালেন পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘গ্রেপ্তারের পর বললেন কোটি কোটি টাকার বিষ উদ্ধার করেছেন। পরে জানা গেল বিষ নেই। এতে করে ওই ইউনিট বা সংস্থার অর্জন নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। সাধারণ মানুষের মনে আস্থার সংকট তৈরি হয়।’

দক্ষিণখানে র‌্যাবের অভিযান ও সাপের বিষ উদ্ধারের বিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তথ্য পেয়ে অভিযান পরিচালনা করেছি। পরে ল্যাব টেস্টে হয়তো জানা গেছে যে এতে বিষ নেই, কিন্তু টেস্ট করার আগে তো বলার সুযোগ নেই যে এখানে বিষ নেই।

‘আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাতেই আমাদের বলতে হয়। আমরা সাপের বিষসহ আসামিদের গ্রেপ্তার করেছি। সাপের বিষ হয়তো পাওয়া যায়নি, কিন্তু প্রতারকদের তো পাওয়া গেছে। যারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছিল।’

গত বছরের নভেম্বরে গাজীপুরের কালিয়াকৈর থেকে প্রায় ৯ কোটি টাকা মূল্যের সাপের বিষ উদ্ধারের কথা জানায় পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে খুলনায় আনুমানিক ১০০ কোটি টাকা মূল্যের সাপের বিষ উদ্ধার করে র‌্যাব-৬। এ ঘটনায় তিনজনকে আটক করা হয়। ছয়টি সিল করা বোতলে সাপের ১৬ পাউন্ড বিষ উদ্ধার করা হয় বলে জানায় র‌্যাব।

এ বছরের জুলাই মাসে হবিগঞ্জ থেকে ৯ কেজি সাপের বিষসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। জানানো হয়, এর মূল্য ৯০ কোটি টাকা।

বিভিন্ন অভিযানে কোটি কোটি টাকা মূল্যের যে পরিমাণ সাপের বিষ উদ্ধার হয়, তার কোনোটাতেই সাপের বিষের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা চোরাচালানের তথ্য পেলেই তা ঠেকাতে অভিযান পরিচালনা করি। অভিযানে সাপের বিষসদৃশ কিছু উদ্ধারের পরই পরীক্ষা না করে বলার উপায় নেই যে সাপের বিষই রয়েছে। সে ক্ষেত্রে শব্দচয়নে আরও সতর্ক হতে হবে।’

সাপের বিষ নিয়ে গবেষণার জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গড়ে তোলা হয়েছে ভেনম রিসার্চ সেন্টার।

এ প্রকল্পের প্রধান গবেষক ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘খুব সীমিতসংখ্যক কাজে সাপের বিষ ব্যবহার করা হয়। সাপের বিষ দিয়ে উচ্চ পর্যায়ের গবেষণা হয়, কিছু ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এটা ব্যবহার করে। আর কিছু অবৈধ ব্যবহার আছে। অনেক বলে নেশা করে। আসলে সাপের বিষ নেশা করার বস্তু না। কিছু হার্বাল মেডিসিন হয়, চায়না ও ওই অঞ্চলে। কিন্তু সাপের বিষের চাহিদার কথা যেভাবে বলা হয়, তা সম্পূর্ণ আলাদা।’

গবেষণা বা ফার্মাসিউটিক্যালে ব্যবহারের জন্য সাপের বিষ বৈধ সোর্স থেকেই সংগ্রহ করা হয় বলে জানান এই গবেষক। বলেন, সাপের বিষের বৈধ যে চাহিদা, তা বৈধভাবেই সংগ্রহ করা হয়। যাদের চাহিদা আছে, তারা কোনোক্রমেই যে কারো কাছ থেকে সাপের বিষ কিনবে না। কারণ একটা সাপের বিষ যখন ব্যবহার করা হবে, তখন ওই সাপের বিষ কোথায় থেকে এসেছে, কোন সাপ থেকে নেয়া হয়েছে, কোন অঞ্চলের সাপ, সার্টিফাইড কি না, তা না জেনে কোনোভাবেই ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি বা কোনো গবেষক নেবেন না।’

বিভিন্ন সময় উদ্ধার হওয়া সাপের বিষের অস্তিত্ব ল্যাব টেস্টে পাওয়া যায় না বলে জানান সহযোগী অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষও।

তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময় সাপের বিষ উদ্ধারের খবর পাই, কিন্তু ল্যাবটেস্টে বিষ পাওয়া যায় না। দেখা যায়, জারভর্তি পাউডার, যা নাকি সাপের বিষ। আমরা আমাদের ভেনম রিসার্চ সেন্টারে রিসার্চের জন্য যে সাপের বিষ সংগ্রহ করি তা পরিমাণে খুবই কম।

‘একটা সাপ থেকে তিন-চার ফোঁটা পেলেই খুশি হয়ে যাই। আর সেই জায়গায় সাপের বিষ তরল অবস্থা থেকে ড্রাই করে এক জার বানানো অনেক বড় বিষয়। একই প্রজাতির হাজারো সাপের বিষ লাগবে। ফলে সাপের বিষ বিক্রির নামে যা হয় তার সবই প্রতারণা।’

বাংলাদেশে শুধু সরকারিভাবে ভেনম রিচার্স সেন্টারে সাপের বিষ গবেষণার জন্য সংগ্রহ করা হয় বলে জানান অনিরুদ্ধ ঘোষ।

এ বিভাগের আরো খবর