ফেনী নদীর ভাঙন জেলার ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তীব্র হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, একটি প্রভাবশালী চক্র নদীর চর, এমনকি সমতল থেকেও বালু তুলছে। এ কারণে ভাঙন এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিলীন হচ্ছে একের পর এক জমি।
জেলার নদী রক্ষা কমিটির আশঙ্কা, ভাঙন শেষে উল্টো চিত্র মিলবে ফেনী নদীর ভারতীয় অংশে। বাংলাদেশ অংশে ভাঙনে চর জাগবে ভারতের অংশে। এখন বন্যার কারণে ঠিকমতো বোঝা না গেলেও পানি কমে গেলে দেখা যাবে ফেনী জেলার আয়তন গেছে কমে।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, জরিপ না করে এ আশঙ্কার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে না।
জেলার জগন্নাথ সোনাপুর, জয়পুর, জয়চাঁদপুর, মুহুরি, ধুমঘাট ব্রিজ, অলি নগরের পশ্চিমাঞ্চল, ঘোপাল ইউনিয়নের লাঙ্গমোড়া গ্রাম, ধুপঘাট ব্রিজ, শুভপুরসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় ভাঙছে নদী।
বালু মহালগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, সরকারি নীতিমালা অমান্য করে বালু তুলছে প্রভাবশালী মহল। ইজারা নেয়া মহালের বাইরে গিয়ে বালু তোলায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নদী ও এর আশপাশের এলাকা।
অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের ফলে প্রতি বছর নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার একর ফসলি জমি। বিলীন হচ্ছে বসতভিটা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বিভিন্ন অংশও।
ফেনী প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, জেলার চার উপজেলায় আটটি বালুমহাল রয়েছে। এর মধ্যে পরশুরামে মুহুরী নদীর দুটি বালুমহাল, ছাগলনাইয়া উপজেলায় ফেনী নদীর দুটি বালুমহাল, একই উপজেলার ফুলছড়ি ছড়া ও মহামায়া ছড়া, উদয় মহাজনের চরে শুভপুর ব্রিজ বালুমহাল এবং সোনাগাজী উপজেলার সোনাপুর বালুমহাল।
এর মধ্যে সদর উপজেলায় মহুরী নদীর বালু মহালটির আয়তন ১০ একর থেকে বেড়ে ১২৯ একরে দাঁড়িয়েছে। তবে এক যুগ পার হয়ে গেলেও এ মহালটি ইজারা হয়নি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এ মহালটি ইজারার জন্য প্রতি বছর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলেও প্রভাবশালী মহল সিন্ডিকেট তৈরি করে অন্যদের দরপত্র জমা দিতে বাধা দেয়। এভাবেই বছরের পর বছর বিনা ইজারায় কোটি টাকার বালু অবৈধভাবে উত্তোলন করে যাচ্ছে চক্রটি। প্রতি বছর কোটি টাকার বালু উত্তোলন হলেও বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর এ মহালটির ইজারা মূল্য ধরা হয় ৪৪ লাখ টাকা। সেই হিসাবে ইজারা না হওয়ায় এক যুগে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে প্রায় ৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
জেলার অপর সাতটি বৈধ বালুমহালের মধ্যে পরশুরামে মুহুরী নদীর বালুমহালের আয়তন প্রায় ৩৩ একর। এটি চলতি বছর ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ইজারা দেয়া হয়েছে।
ছাগলনাইয়া উপজেলায় ফেনী নদীর একটি বালু মহালের আয়তন প্রায় ২৪ একর। চলতি বছর ইজারা দেয়া হয়েছে ১৩ লাখ ২৬ হাজার টাকায়।
ফুলছড়ি ছড়ার প্রায় ৩ একর ১১ শতাংশের বালু মহালটি ইজারা দেয়া হয় ৭ লাখ টাকায়।
এ উপজেলায় ফেনী নদীতে আরেক বালু মহালের আয়তন প্রায় ১৫ একর। চলতি বছর ৪৪ লাখ ১০ হাজার টাকায় এটি ইজারা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া একই উপজেলার মহামায়া ছড়া বালুমহালটি ২ লাখ ৬০ হাজার টাকায় ইজারা দেয়া হয়েছে।
সোনাগাজীর সোনাপুর বালুমহালটি ২৭ লাখ টাকায় এবং চর দরবেশ বালুমহাল ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকায় ইজারা দেয়া হয়েছে।
নির্ধারিত মহালের বাইরে গিয়ে বালু উত্তোলন
জেলা প্রশাসনের তালিকায় আটটি বালুমহাল থাকলেও ৩০ থেকে ৩৫টি স্থানে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হয়। তবে এসব বালু উত্তোলনকারীদের সঠিক কোনো তালিকা নেই স্থানীয় প্রশাসনের কাছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, ছাগলনাইয়া উপজেলায় উদয় মহাজনের চরে শুভপুর ব্রিজের গোড়ার বালুমহালটি দরপত্রের শর্তে অনুযায়ী, সেতুর আধা কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন না করার নির্দেশনা দেয়া হয়। তবে ইজারাদার তা অমান্য করে সেতুর আশপাশ থেকে বালু উত্তোলন করায় শত বছরের ঐতিহ্য এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত সেতুটি ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে।
ছাগলনাইয়া উপজেলার বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন জানান, ফেনী নদীর অব্যাহত ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে রাস্তা, ফসলি জমি ও মাছের ঘের। আর ভারতের অংশে ভরাট হচ্ছে নদীর পাড়। অব্যাহত ভাঙন ঝুঁকির মুখে রয়েছে চট্টগ্রামের মিরসরাই অংশে এশিয়ার সর্ববৃহৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিল্পনগরের সংযোগ বেড়িবাঁধ, সড়ক ও বৈদ্যুতিক লাইন।
আরেক বাসিন্দা শাহ আলম বলেন, ‘অবৈধভাবে ছোট ছোট মেশিন দিয়ে নদীর পাড় থেকে তোলা হচ্ছে বালু। এ ছাড়া চর কেটেও বালু তোলা হচ্ছে। এভাবে বালু তোলায় মারাত্মক ঝুঁকিতে জনপদটি।’
জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ উল হাসান বলেন, ‘চট্টগ্রামের কিছু প্রভাবশালী ফেনীর সীমানায় এসে বালু তোলায় আমরা বিপাকে পড়েছি। এতে দুই জেলায় সমন্বয় করে অভিযান পরিচালনা করতে হয়। এ ছাড়া গত তিন মাসে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেলায় ১০টি অভিযান চালনো করা হয়েছে। এতে তিনজনকে কারাদণ্ডসহ ১২ জনকে অর্থদণ্ড দেয়া হয়।’
‘অবৈধ বালু উত্তোলনের ব্যাপারে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না যে যত প্রভাবশালীই হোক।’
তিনি আরও বলেন, ‘চর কেটে বালু তোলার ব্যাপারে কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ফেনী জেলার নদী রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক এবং সরকারি কমিটির সদস্য গোলাম নবী বলেন, ‘ফেনী নদী থেকে বালু তোলা হচ্ছে আমাদের দেশের অংশে। অন্যদিকে ভারতের অংশে তোলা হচ্ছে না। এতে করে আমাদের দেশের মানচিত্র সংকুচিত হচ্ছে। অন্যদিকে ভারতে ভরাট হচ্ছে।
‘অচিরেই এটি বন্ধ করা না হলে আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। এখনই সবাইকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। আমি সরেজমিনে তদন্ত করে বিভিন্ন স্থানে বালু তোলার দৃশ্য দেখেছি।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহির উদ্দিন বলেন, ‘মানচিত্র সংকুচিত হওয়ার ব্যাপারটি আমরা জরিপ করে দেখব। তবে আমরা জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়েছি।
‘আমাদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নাই, যে কারণে আমরা অভিযান চালাতে পারি না। ইউএনওদের মাধ্যমে অভিযান চালাতে হয়। প্রশাসনকে অনুরোধ করেছি যাতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করা হয়।’