চাঁদপুর শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পরিত্যক্ত প্লাস্টিকসামগ্রী দিয়ে তৈরি হচ্ছে কেঁকড়া সুতা। শুধু তাই নয়, রিসাইকেল করা পরিত্যক্ত প্লাস্টিক রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এতে এক দিকে যেমন পরিবেশ দূষণ কমছে, অন্যদিকে তৈরি হয়েছে কর্মসংস্থান।
চাঁদপুরের পুরানবাজার এলাকায় ‘জুঁই প্লাস্টিক প্রোডাক্টস’ নামে ব্যতিক্রমী এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা ২০১০ সালে উত্তম কুমারের হাতে। তার দেয়া নামে কেঁকড়া সুতা এখন চাঁদপুর ছাড়াও আশপাশের জেলায় সরবরাহ হচ্ছে। দৈনন্দিন কাজে ব্যবসায়ীদের কাছে এই সুতার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
উত্তম কুমার বলেন, বিভিন্ন বাড়ি, শহরের আনাচ-কানাচে পড়ে থাকা পরিত্যক্ত প্লাস্টিকসামগ্রী ভাসমান বিক্রেতাদের কাছ থেকে কেনা হয়। কারখানায় নিয়ে পানি দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করে দুটি গ্রেডে ভাগ করা হয় প্লাস্টিক।
বোতলের প্লাস্টিক মেশিনে কুচিকুচি করে কেটে বিদেশে রপ্তানি করার উপযোগী করা হয়। অন্যান্য প্লাস্টিক পণ্য রিসাইকেল করে সেগুলো দিয়ে তৈরি করা হয় কেঁকড়া সুতা।
তিনি বলেন, কারখানায় রিসাইকেল করা পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের গুড়ো রপ্তানি হয়ে থাকে চীন, জাপান, তাইওয়ান, সৌদি আরব, ভারত, ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। আর কেঁকড়া সুতা চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, শরীয়তপুর, লক্ষ্মীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে। দাম কম থাকায় প্রতিনিয়ত চাহিদা বাড়ছে এই সুতার।
তিনি বলেন, ‘করোনাকালে রপ্তানিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে, তাই এসব মালের কিছুটা সাভার ও গাজীপুরের বিভিন্ন প্লাস্টিক কারখানায় সরবরাহ করছি। তারা এই প্লাস্টিক দিয়ে প্রথমে তুলা বানায়, পরে তা থেকে সুতা তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করে থাকে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও এখান থেকে পুরোদমে রপ্তানি শুরু হবে।’
এই কারখানায় কর্মরত শ্রমিক শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমি এহন (এখানে) প্রায় ৪ বতছর (বছর) ধইরা কাম (কাজ) করি। আমরা টোকাইগোত্তনে (টোকাইদের থেকে) প্লাস্টিকের ভাঙাচুরা পাওয়ার পরে হেগুলা (সেগুলো) বালা কইরা (ভালো করে) পানি দিয়া ধুই। পরে পানির বোতল, কোক, আরসি, সেভেন আপসহ বিভিন্ন প্লাস্টিক বোতলগুলা আলাদা করি। হেগুলো আবার কালার অনুযাই আলাদা কইরা মিশিনে কুটিকুটি কইরা কাটি। পরে এগুলা ৫০ কেজি, ৬০ কেজি ৭০, ১০০ কেজি পরিমাণ কইরা বস্তায় ভইরা সংরক্ষণ করি, যা পরে বিদেশো রপ্তানি করে।’
জুঁই প্লাস্টিক প্রোডাক্টসের প্রতিষ্ঠাতা উত্তম কুমারআরেক শ্রমিক আল আমিন বলেন, ‘বোতলের বাইরে প্লাস্টিকের ভাঙা চেয়ার, বদনা, বালতি, খেলনাসহ অন্যান্য যেই জিনিসপত্র আছে হেই দিয়া আমরা সুতা তৈয়ার করি। পরতমে (প্রথমে) এগুলা পানি দিয়া ভালা কইরা ধুই, পরে মিশিনে গালাইয়া (গলিয়ে) প্লাস্টিকের সুতা বানাই। এই কাম কইরা যেই মজুরি পাই, হেই দিয়া মোটামোটি ভালাই আছি পরিবার লইয়া।’
কারখানার মালিক উত্তম কুমার বলেন, ‘আমার এই কাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্তত ২ হাজার মানুষ জড়িত আছে। বর্তমানে আমার কারখানায় ৩০ থেকে ৩৫ জন পুরুষ-নারী শ্রমিক কাজ করে। তারা এ প্রতিষ্ঠানে দৈনিক হাজিরায়, আবার কেউ মাসিক বেতন ভিত্তিতে কাজ করে তাদের সংসার চালাচ্ছে।
‘প্রতিদিন এই কারখানায় গড়ে দেড় থেকে দুই টন প্লাস্টিক রিসাইক্লিং করা হয়। এতে শ্রমিকদের মজুরি ও কারখানা ব্যয় পরিশোধ শেষে মাসে অর্ধলক্ষাধিক টাকা লাভ হয় আমার।
‘আমি মনে করি এই কাজের মাধ্যমে আমার ব্যবসার পাশাপাশি মানবসেবাও হচ্ছে। পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এই প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পারছি। একই সঙ্গে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করা গেছে। সরকারি সহায়তা পেলে আরও বড় পরিসরে কারখানা দেয়ার ইচ্ছা আছে আমার।’
চাঁদপুর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘সারা বিশ্বেই প্লাস্টিক বর্জ্য একটি গুরুতর সমস্যা। যা দিন দিন মানব সমাজের জন্য আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। সমাজের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব পরিত্যক্ত প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইক্লিং করে ব্যবহার উপযোগী করলে পরিবেশ দূষণ অনেকটা কমে আসে।
‘চাঁদপুরে যেই কারখানা গড়ে উঠেছে, এর মাধ্যমে পরিবেশ দুষণরোধের পাশাপাশি বেকার মানুষের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হয়েছে। এটি অত্যন্ত ভালো একটি উদ্যোগ বলে আমরা মনে করি।’