উত্তাল সমুদ্রের জন্য দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন পর্যটকদের জন্য খোলা থাকে সাধারণত পাঁচ থেকে ছয় মাস। সাধারণত অক্টোবরে জাহাজ চালুর পর দ্বীপটিতে যান পর্যটকরা।
পর্যটকদের আনা-নেয়ায় এ সময় টেকনাফ থেকে ছয়টি ও কক্সবাজার থেকে একটি জাহাজ চলাচল করে কক্সবাজার-টেকনাফ রুট হয়ে সেন্টমার্টিনে। আর সারা বছর দ্বীপবাসী চলাচলের জন্য ব্যবহার করেন প্রায় দুই শতাধিক ট্রলার।
তবে এ বছর পর্যটন মৌসুম শুরুর আগেই দেখা দিয়েছে শঙ্কা। কারণ জাহাজ ও ট্রলার ভেড়ার জন্য দ্বীপের একমাত্র জেটিটির অনেক অংশ ভেঙে পড়েছে।
গত বছর থেকেই এ জেটিতে ভিড়তে পারছে না পর্যটকবাহী জাহাজ। জেটির আগে নোঙর করে সেখান থেকে যাত্রীদের নৌকায় দ্বীপটিতে নেয়া হয়। এক বছরেও জেটি সংস্কার না করায় পর্যটকের সংখ্যায় ধস নামবে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।
গাঢ় নীল পানি ঘেরা সেন্টমার্টিন দ্বীপ কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার একটি ইউনিয়ন। প্রায় ৮ বর্গকিলোমিটারের দ্বীপটিতে রয়েছে ছোট-বড় ১০০টি আবাসিক হোটেল, কটেজ ও রেস্তোরাঁ, প্রায় ২০০টি দোকান, ২০০টি ভ্যান ও রিকশা এবং ২৫টি সার্ভিস বোট।
এই দ্বীপে বাস করেন প্রায় ১২ হাজার মানুষ। তাদের মধ্যে স্থায়ী বাসিন্দা প্রায় ১০ হাজার। তাদের জীবিকার প্রধান মাধ্যম মাছধরা হলেও পর্যটক মৌসুমে তাদের বাড়তি উপার্জন হয়। এ জন্য তারা পর্যটকের প্রতীক্ষায় থাকেন।
ধসে গেছে ট্রলার ভেড়ার স্থানটিও
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রায় দেড় যুগ আগে তৈরি করা জেটিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে একাধিকবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর অবস্থা আগে থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এখন পুরোপুরিই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
তারা আরও জানান, গত বছর সেন্টমার্টিনে সেসব জাহাজ চলাচল করে সেগুলো জেটি থেকে একটু দূরে সাগরে নোঙর করে। এরপর নৌকায় করে পর্যটকদের নেয়া হয় দ্বীপে। এতে পর্যটকরা চরম দুর্ভোগে পড়েন।
স্থানীয় প্রশাসন জানায়, ২০০৪ সালে ২ কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক জেটিটি নির্মাণ করা হয়। তবে সংস্কারের অভাবে এতদিনে জেটির রেলিংয়ের পূর্ব পাশের পার্কিং এবং গাইড ও স্প্রিং বিম সাগরে বিলীন হয়েছে। জেটির নিচে বেশির ভাগ পলেস্তারা খসে পড়েছে। রড বেরিয়ে এসেছে। এ কারণে জেটিতে জাহাজ ভিড়তে পারছে না।
পর্যটন উদ্যোক্তা তোফায়েল আহম্মেদ জানান, গত কয়েক বছরে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে জেটির অনেকাংশ ভেঙে পড়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে পনটুন।
সবশেষ গত ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জেটিটি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জেটির পাশে ট্রলার ভেড়ানোর অংশটিও ভেঙে গেছে। এতে জেটিতে কোনো নৌযানই ভিড়তে পারছে না।
এমন অবস্থায় দ্বীপের পর্যটন ব্যবসায়ীরা অনেকটাই দিশেহারা। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পর এখন মূলধন হারানোর শঙ্কা করছেন অনেকে।
সেন্টমার্টিন হোটেল সী-প্রবালের পরিচালক আবদুল মালেক জানান, জেটিটির গাইড বিম ভেঙে গেছে। বোট সেখানে ভিড়তে পারে না। বিকল্প ব্যবস্থায় যাত্রী ওঠানামা করাতে অসুবিধা হয়।
জেটিটি দ্রুত সংস্কারের দাবি জানান তিনি।
কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিনগামী এমভি কর্ণফুলী এক্সপ্রেস জাহাজের ইনচার্জ বাহাদুর বলেন, ‘মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষ যেতেন সেন্টমার্টিনে। তবে জেটিটি সংস্কার না হওয়ায় পর্যটক ও দর্শনার্থীরা ঝুঁকি নিয়ে যেতে চান না।’
কেয়ারী সিন্দাবাদ জাহাজের কর্মকর্তা এ কে এম আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পর্যটকদের নির্বিঘ্নে ওঠানামা করতে নতুন জেটি নির্মাণের বিকল্প নেই। যত দ্রুত তা করা হবে, ততই মঙ্গল হবে।’
শুধু ব্যবসায়ী ও জাহাজমালিকরা নন, দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন দ্বীপের বাসিন্দারাও।
কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সদস্যসচিব এইচ এম নজরুল ইসলাম জানান, দ্বীপের কোনো মানুষ অসুস্থ হলে জেটি ব্যবহার করে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে টেকনাফে নেয়া এখন সম্ভব নয়। দ্বীপবাসী তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য আনা-নেয়াও ঠিকমতো করতে পারছেন না।
জেটিটি দ্রুত সংস্কার করা না হলে এই খাতে সম্পৃক্ত প্রায় ৫০ হাজার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির শিকার হবেন বলেও জানান তিনি।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্যানেল চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান হাবিব খাঁন বলেন, ‘অপূর্ব সুন্দর স্থান এই সেন্টমার্টিন দ্বীপ। চারদিকে সাগরের স্বচ্ছ নীল পানি। দ্বীপের মানুষগুলোও অসম্ভব ভালো। এখানে চুরি-ডাকাতির কোনো রেকর্ড নেই।
‘পর্যটকরা সারা রাত সৈকতে থাকলেও কোনো সমস্যা হয় না। তবে যেখান দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক আসেন, সেই জেটিই ভাঙা।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ জানান, প্রতিবছর এ সময় সাধারণত দেশি-বিদেশি লক্ষাধিক পর্যটক আসেন। তবে জেটি ব্যবহার না করতে পারলে পর্যটকরা আসতে চাইবেন না।
তিনি আরও জানান, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা প্রশাসন বেশ কয়েকবার জেটি সংস্কারের আশ্বাস দিলেও এখনও কোনো কাজ শুরু হয়নি। তবে তিনি চেষ্টা করছেন।