‘শরিয়তসম্মত বিনিয়োগের’ কথা বলে গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান ও তার তিন ভাইকে রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ।
পিরোজপুরের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে সোমবার দুপুরে রিমান্ডে নিতে পুলিশ আবেদন করলে বিচারক মো. মহিউদ্দীন তাদের সাত দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন।
পিরোজপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আ জ মো. মাসুদুজ্জামান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আসামিরা হলেন পিরোজপুরভিত্তিক এমএলএম কোম্পানি এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান মাওলানা রাগীব আহসান এবং তার তিন ভাই মাওলানা আবুল বাশার, খাইরুল ইসলাম ও মুফতি মাহমুদুল হাসান। এর মধ্যে আবুল বাশার প্রতিষ্ঠানটির সহপরিচালক।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর তোপখানা রোড এলাকা থেকে রাগীব আহসান ও আবুল বাশারকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। সে রাতেই পিরোজপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় অন্যদের।
পিরোজপুর সদর উপজেলার খলিশাখালী এলাকায় ২০১০ সালে শুরু হয় এহ্সান রিয়েল এস্টেট নামের একটি প্রতিষ্ঠান। পরে কোম্পানির নাম পরিবর্তন করা হয়।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে গত শুক্রবার বিকেলে রাগীবের বিরুদ্ধে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
পিরোজপুর সদরের এই ভবনে ছিল এহসান গ্রুপের কার্যালয়
তিনি জানান, ‘শরিয়তসম্মত সুদবিহীন বিনিয়োগ’ কেমন হবে, তার প্রচার চালিয়ে হাজার হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
ব্যবসার ফাঁদ পাতা হয়েছে ওয়াজ মাহফিলসহ ধর্মীয় মজলিসে, ব্যবহার করা হয়েছে ইমাম, মাদ্রাসার শিক্ষক, ছাত্রদের। তারা শরিয়তসম্মত বিনিয়োগের কথা শুনে অকাতরে টাকা ঢেলেছেন, এরপর ঠকেছেন।
এই কোম্পানির মাধ্যমে আনুমানিক ১৭ হাজার কোটি টাকা রাগীব হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তার বিরুদ্ধে ১৫টির বেশি মামলা রয়েছে এবং তিনি এর আগে একবার জেলও খেটেছেন।
র্যাব কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে এমএলএম কোম্পানির নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় ভুক্তভোগীরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, পিরোজপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলায় মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেন। তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরপর তাকে (রাগীবকে) গ্রেপ্তার করা হয়।’
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাগীব আহসান তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ স্বীকার করে নানা তথ্য দিয়েছেন বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে হাজির করা হয় রাগীব ও তার সহযোগী আবুল বাশার
ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে টাকা উত্তোলন
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রাগীব মূলত ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিকে অপব্যবহার করে এমএলএম কোম্পানির ফাঁদ তৈরি করেন। ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুক্ত ব্যক্তি, ইমাম ও অন্যদের টার্গেট করেই তিনি কাজ করতেন।
তিনি 'শরিয়তসম্মত সুদবিহীন বিনিয়োগ'-এর বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করেন। ওয়াজ মাহফিলেও ব্যবসায়িক প্রচারণা চালানো হতো।
তিনি লাখ টাকার বিনিয়োগে মাসে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার প্রলোভন দেখান। এভাবে ২০০৮ সালেই ১০ হাজার গ্রাহককে যুক্ত করতে সমর্থ হন। গ্রাহকের সংখ্যা একপর্যায়ে ছাড়িয়ে যায় লক্ষাধিক।
র্যাব কর্মকর্তা জানান, রাগীব হাউজিং ল্যান্ড প্রজেক্ট, দোকান, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে সাধারণ গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। তিনি এখন পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদে ১১০ কোটি টাকা সংগ্রহের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘অনেকেই পাওনা টাকার চেক নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। এ ছাড়া অনেকেই ভয়ভীতি, লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হতেন বলে ভুক্তভোগীরা জানান।’
রাগীব আহসানের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরছেন র্যাব কমান্ডার খন্দকার আল মঈন
তিনি কত টাকা আত্মসাৎ করেছেন এবং এই টাকা জঙ্গি তৎপরতায় ব্যবহার হতো কি না, এমন প্রশ্নে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘বিভিন্ন ভুক্তভোগীর তথ্য, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে আনুমানিক তিনি ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
‘আত্মসাৎকৃত টাকা জঙ্গি তৎপরতায় ব্যবহার হয়েছে কি না, সেটা আমাদের গোয়েন্দারা খতিয়ে দেখবেন।’
ঠকিয়েছেন কর্মচারীদেরও
র্যাব জানায়, রাগীবের প্রায় তিন শ কর্মচারী ছিল। তাদের নির্ধারিত কোনো বেতন দেয়া হত না।
কর্মচারীরা মাঠপর্যায় থেকে বিনিয়োগকারী গ্রাহক সংগ্রহ করে থাকেন। তাদের গ্রাহকের বিনিয়োগের ২০ শতাংশ অর্থ দেয়ার প্রলোভন দেখানো হয়। আর তারাও দ্রুত গ্রাহক বাড়াতে থাকেন। তবে পরে গ্রাহকদের মতো প্রতারিত হন তারাও।