কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে গত মৌসুমের মতো এবারও ব্যর্থ হয়েছে রংপুর খাদ্য বিভাগ। চলতি বোরো মৌসুমে আট উপজেলার কৃষকের কাছ থেকে ১৭ হাজার ৪০৩ টন ধান কেনার কথা থাকলেও নেয়া হয়েছে মাত্র ৭ হাজার ১৮২ দশমিক ৪৪০ টন।
কৃষক নেতাদের অভিযোগ, ধান সংগ্রহের জন্য কৃষক বাছাইয়ের যে প্রক্রিয়া, তা স্বচ্ছ না। প্রকৃত কৃষকরা এ কারণে ধান দিতে পারছেন না। তবে খাদ্য বিভাগ জানিয়েছে, স্থানীয় বাজারে দাম ভালো পাওয়ায় কৃষকরা তাদের কাছে ধান বিক্রি করেন না।
এর আগের আমন মৌসুমে ১০ হাজার ৩৮২ টন ধান সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত থাকলেও কেবল পীরগঞ্জ থেকে কেনা হয়েছে ২ টন। অন্য সাত উপজেলা থেকে এক ছটাক ধানও সংগ্রহ করতে পারেনি জেলা খাদ্য বিভাগ।
ধান দিতে না পারায় ক্ষুব্ধ কৃষকরা
রংপুর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কৃষক আশরাফুল আলম বলেন, ‘কোন দিন কীভাবে লটারি হয়েছে, আমরা জানি না। কম হোক, বেশি হোক, আমরা গ্রামে ধান বিক্রি করেছি।
‘অনেকের থেকে শুনেছি, এর ওর নাম লটারিতে উঠেছে। ওদের ধান কোনোদিন বাড়িতে গেছে বলে দেখিনি। ওরা কীভাবে কৃষক হলো? মৌসুমে ধান কমদামে বিক্রি করেছি। এখন এসব কথা বলে কোনো লাভ নাই।’
কৃষক আরিফুল ইসলাম, মজিবর রহমান, জয়নাল আবেদীনসহ অনেকেই জানালেন, লটারিতে তাদের নাম ধান বিক্রয়কারী কৃষকের তালিকায় ওঠেনি।
যেভাবে ধান সংগ্রহ হয়
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমন ও বোরো মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে ধান কেনার জন্য লটারি করে উপজেলা ধান-চাল ক্রয় কমিটি।
নীতিমালা অনুযায়ী, প্রত্যেক উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এই কমিটির সভাপতি। এর সদস্য উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, খাদ্য নিয়ন্ত্রকসহ কয়েকজন।
উপজেলায় ধান চাষ করেছেন এমন কৃষকের তালিকা থাকে কৃষি অফিসে। তাদের মধ্য থেকে যারা কৃষি ভর্তুকি পান, তাদের নাম যায় ক্রয় কমিটির প্রধানের কাছে। এটি সরবরাহ করেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।
ওই তালিকা থেকে লটারির মাধ্যমে কৃষক বাছাই করে ক্রয় কমিটি। বাছাইয়ের তালিকা উপজেলা চত্বর ও উপজেলা খাদ্যগুদামের সামনে টানিয়ে দেয়া হয়।
এই প্রক্রিয়ার সময় কৃষকরা কোথাও উপস্থিত থাকেন না। অনেকে জানেনই না যে তার নাম লটারিতে উঠেছে।
এতে দেখা যায়, তালিকায় থাকা অনেক কৃষক ধান দিচ্ছেন না। আবার ধান থাকা সত্ত্বেও তালিকায় নাম নেই বলে বিক্রি করতে পারছেন না অনেকে। এসব কারণে সংগ্রহের লক্ষ্যও পূরণ হচ্ছে না।
রংপুর কৃষক সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক পলাশ কান্তি নাগ বলেন, ‘ধান দেয়ার জন্য যে তালিকা অফিসের সামনে ঝোলানো হয়, তা কর্মকর্তাদের করা, নাকি কোনো কৃষকের করা, সেটি বোঝা মুশকিল। কারণ কৃষকরা জানেনই যে তাদের নাম কোনো লটারিতে দেয়া হচ্ছে, কিংবা লটারিতে উঠেছে। জানলে তো তারা অবশ্যই ন্যায্যমূল্যে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতেন।
‘নানা অজুহাত খাঁড়া করে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান না কিনে দালালদের মাধ্যমে তালিকায় কয়েক জনের নাম তোলা হচ্ছে। এতে দালাল-ফড়িয়া ও কিছু অসাধু কৃষি ও খাদ্য কর্মকর্তা লাভবান হচ্ছেন। তালিকায় স্বচ্ছতা থাকতে হবে। কৃষকদের উপস্থিতিতে লটারি করতে হবে।’
পলাশ মনে করেন, হাটে-বাজারে সরকারি উদ্যোগে ক্রয়কেন্দ্র খুলে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা উচিত।
খাদ্য বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রকৃত কৃষকের নাম দেয়ার দায়িত্ব কৃষি বিভাগের। এটি প্রচারের দায়িত্ব তথ্য বিভাগের। পরিসংখ্যান বিভাগ তালিকা সংরক্ষণ করে সমন্বয় করবেন। সব মিলিয়ে যে তালিকা আসবে, সেখান থেকে খাদ্য বিভাগ লটারি করবে। তবে, কৃষি বিভাগ তাদের কাজ ঠিকমতো করে না। সমন্বয়হীনতা রয়েছে তথ্য ও পরিসংখ্যান বিভাগেরও।
‘লটারি হওয়া উচিত কৃষকের উপস্থিতিতে’
দীর্ঘদিন কৃষি নিয়ে কাজ করেন রংপুরের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আফতাব হোসেন। তিনি মনে করেন, উপজেলায় নির্দিষ্ট দিনে প্রকৃত কৃষকদের উপস্থিতিতে লটারি করতে হবে। বিজয়ীদের নাম-মোবাইল ফোন নম্বরসহ তালিকা প্রকাশ করতে হবে। তাহলেই ধান সংগ্রহ সঠিকভাবে হবে।
তিনি বলেন, ‘এখন যে প্রক্রিয়ায় ধান কিনতে লটারি করে কৃষকের নাম বাছাই করা হচ্ছে, তাতে কোনোভাবেই প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা সম্ভব না। এই প্রক্রিয়ায় দালাল, ফড়িয়ার দাপট বেড়ে যাবে, যাচ্ছেও। অস্বচ্ছতা আসবে খাদ্য কর্মকর্তাদের মধ্যে; সে অভিযোগও এর মধ্যে উঠে আসছে। এভাবে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব না।’
আফতাব আরও জানান, খাদ্য বিভাগ যেভাবে কৃষকের কাছ থেকে শুকনো ধান কিনতে চায়, তা কখনই সম্ভব নয়। মাড়াই মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে ধান শুকিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করলে লক্ষ্যও পূরণ হবে, কৃষকরাও লাভবান হবেন।
দায় কৃষকের, বলছে খাদ্য বিভাগ
রংপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুল কাদের নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত আমন মৌসুমে ধান কম কেনা হলেও এবার লক্ষ্যমাত্রার প্রায় অর্ধেক সংগ্রহ করা হয়েছে। এটা অনেক ভালো অর্জন।’
লক্ষ্য পূরণ না হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বাজার দর এবং সংগ্রহমূল্য কাছাকাছি থাকায় কৃষকরা ধান দিতে আগ্রহী হন না।
তিনি জানান, এ মৌসুমে বোরো ধানের সরকারি দাম ছিল প্রতি কেজি ২৭ টাকা। সে অনুযায়ী প্রতি মণ ধানের দাম ১ হাজার ৮০ টাকা। স্থানীয় বাজারে কৃষক ধান বিক্রি করেছে কেজিপ্রতি ২৫ থেকে ২৬ টাকায়। তাদের ক্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসতে পরিবহন খরচ দিতে হয় বলে সরকারি দাম কৃষকদের পোষায় না। এ কারণে তারা ধান দিতে আগ্রহ পান না।
তিনি বলেন, ‘যাদের নাম লটারিতে উঠে তাদের তালিকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে, ইউনিয়ন পরিষদে, খাদ্য অফিসে, অনলাইনে দেয়া হয়। মাইকিং করা হয়। আসলে যখন কৃষকরা বাজারে ভালো দাম পায় তখন তারা সরকারি গুদামে ধান দিতে চায় না।’
কৃষকদের উপস্থিতিতে লটারি করার দাবির বিষয়ে আব্দুল কাদের বলেন, ‘হাটবাজারে গিয়ে ধান কেনা সম্ভব নয়। আমরা যে ধান কিনি, সেই ধান উন্নত মানের, শুকনো। যে ধান কেজিতে ২৮ টাকা দরে কেনা হয়, তা মিলাররা ২৯ টাকা দরে কিনে সে অনুযায়ী চাল দেন। আর কৃষক বাজারে যে ধান বিক্রি করেন তাতে কাঁচা, চিটি, পাতান, খুদ বেশি হয়।
‘ধান কেনার সময় অনেক কিছুই বিবেচনা করে কিনতে হয় যাতে সরকার লাভবান হয়। হাট থেকে কাঁচা, পাতান থাকা ধান কিনলে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাছাড়া বাজারে গিয়ে ধান কেনার মতো লোকবল আমাদের নেই।’