করোনা সংক্রমণের কারণে ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর রোববার থেকে খুলেছে দেশের সব স্কুল-কলেজ। দীর্ঘদিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পদচারণে ফিরেছে প্রাণের উচ্ছ্বাস।
সারা দেশের মতো সিলেটের ১ হাজার ৪৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শুরু হয় শ্রেণি কার্যক্রম। তবে এদিনও বন্ধ ছিল সিলেটের অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এগুলোতে ছিল না শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি। বন্ধ ছিল প্রতিষ্ঠানের ফটকও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় আর্থিক সংকটে পড়েছে এই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। বাসা ভাড়া না দিতে পারায় কয়েকটি স্কুল নিজেদের সাইনবোর্ডও সরিয়ে নিয়েছে।
সিলেটে প্রায় ৫০টি স্কুল করোনা সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এগুলোর বেশির ভাগই কিন্ডারগার্টেন স্কুল। ফলে আজ স্কুল-কলেজ খোলার দিনেও বন্ধ ছিল এগুলো।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো আদতে কার্যক্রম শুরু করতে পারবে কি না, এ নিয়ে সন্দিহান তারা।
সিলেট কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাওলানা বদরুল আলম জানান, জেলায় প্লে গ্রুপ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। এর মধ্যে করোনার কারণে সব গুটিয়ে একেবারে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করেছে অন্তত ৪০টি প্রতিষ্ঠান।
বছর তিনেক আগে সিলেট নগরের সুবিদবাজার এলাকায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে রবীন্দ্র-নজরুল মেমোরিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। করোনা সংক্রমণের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণার পর ছাত্রদের বেতন আটকে যাওয়ায় বাসা ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হয় প্রতিষ্ঠানটির। কোনো ঘোষণা ছাড়াই বন্ধ হয়ে যায় এটি।
এই স্কুলের মতো নগরের বাগবাড়ি এলাকার বিদ্যারণ্য স্কুল অ্যান্ড মহিলা কলেজ, সুবিদবাজারের নলেজ হোম স্কুল অ্যান্ড কলেজ, চৌকিদেখি এলাকার শাহজালাল প্রি-ক্যাডেট একাডেমি, বনকলাপাড়ার সিলসিটি ট্যালেন্ট হোম, শাহপরাণ এলাকার মা-মণি কিন্ডারগার্টেন (দুটি শাখার মধ্যে একটি), উপশহরের হলিসাইড স্কুলসহ নগরের অর্ধশতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করোনায় বন্ধ হয়ে গেছে।
বাসাভাড়া ও অন্য খরচ জমে যাওয়ায় ২০২০ সালের জুনে বন্ধ করে দেয়া হয় সুবিদবাজার এলাকার নলেজ হোম স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়টি যে ভবনে ছিল, সেখানে এখন পাশের এক রেস্টুরেন্টের কর্মীরা ভাড়া থাকছেন। সরিয়ে নেয়া হয়েছে স্কুলের সাইনবোর্ডও।
নলেজ হোম স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. শওকত হোসেন বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী দরিদ্র পরিবারের সন্তান। করোনার সংক্রমণ শুরুর পর থেকে আমরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো বেতন পাইনি। তবু আমরা এক বছরের বেশি সময় বিদ্যালয় খোলার অপেক্ষায় ছিলাম। তবে একপর্যায়ে বিদ্যালয়ের বাসাভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ চালানো আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ধারদেনা করেও শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি টিকিয়ে রাখতে পারিনি।’
এই বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ইমরান তালুকদার বলে, ‘করোনার কারণে আমি বাড়িতে ছিলাম। কয়েক মাস আগে সিলেটে এসে জানতে পারি স্কুল আর কোনো দিন খুলবে না। শিক্ষকরা আমাদের অন্য স্কুলে ভর্তি হতে বলেছেন।’
২০১০ সালে নগরের বাগবাড়ি এলাকায় বিদ্যারণ্য স্কুল অ্যান্ড মহিলা কলেজ শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে। করোনা মহামারিতে তাদেরও শিক্ষা কার্যক্রম স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এই প্রতিষ্ঠানে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি ছিল।
ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, খুলে ফেলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড। বর্তমানে সেখানে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বসবাস করছেন ওই প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মচারী অঞ্জনা মল্লিক।
তিনি বলেন, ‘চলতি বছর প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে আয়া হিসেবে কাজ করতাম। প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে গেছি। আমার স্বামীও এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। তিনিও কাজ হারিয়েছেন। এখন ভ্যান চালান।’
বিদ্যারণ্য স্কুল অ্যান্ড মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মো. মুখলেছুর রহমান বলেন, ‘করোনাকালে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো ধরনের ফি পাইনি। কীভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাব? ফলে কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছি।’
সিলেট কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাওলানা বদরুল আলম বলেন, করোনায় বেসরকারি শিক্ষা খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চলে শিক্ষার্থীদের বেতনে। কিন্তু করোনায় আমরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো বেতন-ফি নিতে পারিনি। এই দুঃসময়ে আমরা সরকারেরও কোনো সহযোগিতা পাইনি। আমাদের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ভবন নেই। ভাড়া ভবনে শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে হয়। ফলে আর্থিকভাবে দেউলিয়া হয়ে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে।
যে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনও টিকে আছে, তারাও রয়েছে সংকটে। দীর্ঘদিনের বন্ধ শেষে আজ থেকে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করলেও আর্থিক সংকটে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
নগরের পীরের বাজার এলাকার মা-মণি কিন্ডারগার্টেনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান ডালিম বলেন, ‘দেড় বছর বন্ধ থাকার কারণে আমাদের স্কুলের বেশির ভাগ ডেস্ক, বেঞ্চ নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক আসবাবপত্রও নষ্ট হয়েছে। এগুলো এখন নতুনভাবে কিনতে হচ্ছে। ফলে এই সংকটেও আমাদের নতুন করে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। এখন বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেরই বিনিয়োগের সামর্থ্য নেই। ফলে যেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়নি, সেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও এখন সংকটে আছে।’