আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে সংলাপের যে প্রস্তাব রেখেছেন, তাতে আপত্তি নেই বিএনপি নেতাদের। তবে কেবল বসার জন্য বসতে চান না তারা। আগেভাগেই সরকারের কাছ থেকে কিছু অঙ্গীকার চান তারা।
বিএনপি নেতারা বলছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তারা সংলাপে বসেছিলেন। কিন্তু তাতে তাদের দাবির কিছুই পূরণ হয়নি।
এভাবে সংলাপে সময়ক্ষেপণ ছাড়া কিছুই হয় না বলে মনে করেন তারা। তাই বিএনপির পক্ষ থেকে যে চারটি দাবি তোলা হয়েছে, সে বিষয়ে সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য আগেই জানতে চায় দলটি।
ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে সংলাপের আহ্বান আসার পর নিউজবাংলাকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির তিনজন সদস্য সংলাপে বসতে নানা শর্তের কথা বলেছেন। তারা বলেছেন, কেবল বসার জন্য বসা হলে তারা সংলাপে আগ্রহী নন। তবে সরকার যদি আগাম পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে আলোচনায় বসতে চায়, তাহলেই তারা আগ্রহী।
সংলাপের প্রসঙ্গ যেভাবে এলো
আগামী জাতীয় নির্বাচনের আরও দুই বছরের মতো সময় বাকি থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর কথাবার্তা, কর্মসূচিতে ভোটের প্রস্তুতির বিষয়টি স্পষ্ট।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এ ক্ষেত্রে এগিয়ে। এরই মধ্যে নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছে তারা। ভোটের সময় অনলাইনে কাজ করতে এক লাখ কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজও শুরু হয়ে গেছে।
বিএনপির বাস্তবতা অবশ্য ভিন্ন। ২০০৭ সালে জরুরি আইন জারির পর থেকেই রাষ্ট্রক্ষমতায় নেই তারা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর উচ্চ আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি বিএনপি।
শনিবার রাজধানীতে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের এক আলোচনায় জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে চারটি শর্ত দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে কর্মসূচি দেয় তারা, কিন্তু সফল হয়নি। পরে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের আগে দলীয় সরকারের অধীনেই ভোটে যায় তারা।
এই ভোটের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে নতুন জোট গঠন করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপেও বসেন বিএনপি নেতারা। সেই সংলাপে নেতৃত্ব দেন সে সময় জোটের প্রধান নেতা হয়ে ওঠা গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন।
তবে ঐক্যফ্রন্ট এখন আর কার্যকর নয়। আর শনিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভোটে যেতে চারটি শর্ত দেন।
- আরও পড়ুন: জাতীয় নির্বাচনে যেতে বিএনপির চার শর্ত
এগুলো হলো নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, তাদের দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তাদের দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা মামলা প্রত্যাহার।
পরদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে সংলাপে বসার প্রস্তাব দেন।
নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হবে জানিয়েও তিনি বলেন, ‘নির্বাচনি ব্যবস্থা কীভাবে জোরদার করা যায়, সে নিয়ে আলোচনা হতে পারে।‘
ভোটে যেতে বিএনপি চার শর্ত দেয়ার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তারা আলোচনায় আগ্রহী
ক্ষমতাসীন দলের এই সংলাপের আহ্বানকে বিএনপি কীভাবে দেখছে, তা জানতে দলটির চারজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা। তাদের মধ্যে একজন মন্তব্য করতে রাজি হননি। বাকি তিনজন নানা শর্তের কথা বলেছেন।
‘সংলাপের বিষয়বস্তু আসলে কী?’
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে জাতীয় সংসদের স্পিকার জমির উদ্দিন সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সংলাপ করতে চায়, এটা তো খুব সুন্দর কথা। প্রশংসা করার মতো। তবে একই সঙ্গে বিষয় এটা যে তাদের কাছে সংলাপের বিষয়বস্তু আসলে কী?
‘বিএনপিকে ডেকে তাদের কীভাবে চুপ করানো যায়, সেই ষড়যন্ত্রের সংলাপ হলে তো বিএনপি সেই ডাকে সাড়া দেবে না। তাই তাদের বলব, আপনারা আগে স্পষ্ট করেন যে সংলাপটা ঠিক কী নিয়ে?’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির তিন নেতা জমির উদ্দিন সরকার, নজরুল ইসলাম খান ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, তারা সংলাপে আগ্রহী তবে আগে সরকারকে পদত্যাগের ঘোষণা দিতে হবে
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সংলাপের বিষয়টি তুলে ধরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতা বলেন, ‘সেই সংলাপের পরবর্তী চিত্র কী তা আপনারা সবাই জানেন। অতএব তারা সংলাপ করতেই পারে। তবে সেটা মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে নাকি, তা তো আগে জানতে হবে।’
‘সময় নষ্ট করার জন্য যাব না’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘উনি (ওবায়দুল কাদের) যদি এমনটা বলে থাকেন, তাহলে আমরা নিজেরা আগে আলাপ করব। তারপরে আমরা সিদ্ধান্ত নেব কী করব।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যে শর্ত দিয়েছি সেসব তো আর নতুন কিছু না। আমরা বরাবরই এগুলো বলে আসছি। এগুলো তো আর শর্তের মধ্যে পড়ে না। এগুলো বেসিক জিনিস। এগুলো না মানা পর্যন্ত তো নামে মাত্র নির্বাচনে যাওয়া যাবে না।
'এখন যদি তারা মনে করে তারা সংলাপে আগ্রহী, সে ক্ষেত্রে আমরা ভেবে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। ফলপ্রসূ হবে কি না, সে বিষয়েও আমাদের ভাবতে হবে। নয়তো সময় নষ্ট না করে আমাদের গতিতেই আমরা এগিয়ে যাব।’
‘আগে পদত্যাগের ঘোষণা দিতে হবে’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়েরও শর্ত আছে সংলাপ নিয়ে। তিনি বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে, তাদের আগে জনসমক্ষে বলতে হবে যে, এই সরকার পদত্যাগ করবে। তারপরে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। শুধু সে ক্ষেত্রেই আমরা সংলাপে যাব।
‘ক্ষমতায় থেকে আরও কতদিন এভাবেই জোরজবরদস্তি করে ক্ষমতায় থাকবেন, সেটা নিয়ে সংলাপ করতে আমরা আগ্রহী না। সেটা হবে আসলে বিলাপ। ওই বিলাপের আমাদের প্রয়োজন নেই।’
সরকারের পক্ষ থেকে আগাম ঘোষণা না এলে আন্দোলনে যাওয়ার কথাও বলেন গয়েশ্বর। বলেন, ‘আগে বলতে হবে তারা পদত্যাগ করবেন। নয়তো আমরা আমাদের যে লক্ষ্য, আমাদের যে চাওয়া, সেটা আমরা আমাদের মতো করেই আদায় করে নেব।
‘আমাদের মরণের সময় এখন। হয় মরব, নয় জয়ী হব। এসব বিলাপে আমরা অংশগ্রহণ করব না।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে যাওয়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রশ্ন শুনে বলেন, ‘আমি তো মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলি না। আপনি মন খারাপ কইরেন না। একটু চেক করে দেখতে পারেন।’