রাজধানীর পুরোনো ও নামকরা সিনেমা হলগুলোর মধ্যে অন্যতম নিউমার্কেট এলাকার বলাকা ও মতিঝিল এলাকার মধুমিতা সিনেমা হল।
বলাকা সিনেমা হল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৪ সালে। একই চত্বরে বলাকা ও বিনাকা নামের দুটি সিনেমা হল ছিল পাশাপাশি। প্রত্যেকটির দর্শক ধারণক্ষমতা ১ হাজার ২৬৫। শুরুর পর থেকে বিভিন্ন ভাষার সিনেমা প্রদর্শিত হলেও ধীরে ধীরে বাংলা ছাড়া অন্য কোনো সিনেমা দেখাত না বলাকা হল কর্তৃপক্ষ।
একই অবস্থা মধুমিতারও। রাজধানীর দর্শকরা জেমস ক্যামেরনের টাইটানিক সিনেমাটি দেখেছিল এই হলে। মধুমিতা সিনেমা হল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৭ সালে। প্রেক্ষাগৃহের দর্শক ধারণক্ষমতা ১ হাজার ২২১।
দুটি সিনেমা হলই এখন বন্ধ। কবে খুলবে, তার নিশ্চয়তা নেই।
প্রযোজক নেতা ও সনি স্কয়ারের (সনি সিনেমা) মালিক মোহাম্মদ হোসেন বলাকা সিনেমা হল নিয়ে নিউজবাংলাকে বলেছিলেন, ‘বলাকাকে আধুনিক করা হবে। তাই এটা চালু হতে সময় লাগবে।’
অন্যদিকে মধুমিতা সিনেমা হলের মালিক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ এর আগে নিউজবাংলাকে জানিয়েছিলেন, সেপ্টেম্বরে থেকে চালু হবে মধুমিতা। কিন্তু সেপ্টেম্বরে কোনো সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে না, তাই হলটি চালুও হচ্ছে না।
অনেক দিন থেকেই প্রেক্ষাগৃহটি আধুনিকায়ন করতে চাইছেন নওশাদ, কিন্তু সিনেমা দেখিয়ে যে টাকা আসে, তা দিয়ে সিনেমা হল আধুনিক করার কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি। তাই তেমন কিছু না করে যেমন ছিল, অনেকটা তেমনই রয়েছে মধুমিতা। হলটি খোলা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
মধুমিতার পাশেই টিকাটুলি এলাকার সিনেমা হল অভিসার। রাজধানীর পুরোনো সিনেমা হলগুলোর মধ্যে এটিও অন্যতম। ১৯৭৫ সালে নির্মিত হয় হলটি।
রাজধানীর মধুমিতা সিনেমা হলটি চলতি মাসে খোলার কথা থাকলেও কোনো সিনেমা মুক্তি না পাওয়াই এখনও খোলেনি। ছবি: সংগৃহীত
এই হল দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি অংশ অভিসার সিনেমা হল নামে পরিচিত এবং অপর অংশটি পরিচিত নেপচুন সিনেমা হল নামে। কিন্তু নেপচুনে সিনেমা প্রদর্শন আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। দুটি হল মিলে আসনসংখ্যা ছিল ১ হাজার ১৩৭।
অভিসারও বন্ধ। কবে খুলবে জানা নেই কারও। প্রেক্ষাগৃহের সামনে থাকা নিরাপত্তা প্রহরীকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, মালিক দেশের বাইরে, কবে আসবে তিনি জানেন না।
সহজে খুলছে না হল
প্রদর্শক সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মিঞা আলাউদ্দিন নিউজবাংলাকে জানান, এসব হল খুলতে সময় লাগবে। সহজে খুলছে না। কারণ হল তিনটির মালিকদের সিদ্ধান্ত নেয়া নিয়ে ঝামেলা আছে। তারা কি হল রাখবেন না ভেঙে ফেলবেন, সেটা তারা নিশ্চিত হতে পারছেন না।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সারা দেশে চালু সিনেমা হলের সংখ্যা এখন ৬০টি।’
১৯৬৯ সালে রাজধানীর মতিঝিলে প্রতিষ্ঠিত অভিসার সিনেমা হলটি গত বছর ভেঙে ফেলা হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীতে বন্ধ সিনেমা হলের পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি বলেন, ‘পদ্মা, সুরমা, মল্লিকা, গ্যারিসন, সাগরিকা আগেই বন্ধ হয়েছে। পূর্ণিমা, পূরবী, এশিয়া, পর্বত, রাজমণি, আগমন বন্ধ হয়ে গেছে। আরও থাকতে পারে, এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না।
‘আজাদ, চিত্রামহল, বিডিআর, আনন্দ, জোনাকি (পুরোপুরি নিশ্চিত না), মুক্তি, সৈনিক ক্লাব, পুনম (রায়েরবাগ) চালু রয়েছে।’
সিনেমা হল বা সিঙ্গেল স্ক্রিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি জানান, আগে মানহীন সিনেমা এবং পরবর্তীতে সিনেমার অভাবের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
বাড়ছে মাল্টিস্ক্রিন
সিঙ্গেল স্ক্রিনের যখন এই অবস্থা তখন রাজধানীর মিরপুরে, যেখানে সনি সিনেমা হল ছিল, ঠিক সেখানেই সম্প্রতি চালু হয়েছে স্টার সিনেপ্লেক্সের নতুন শাখা।
স্টার সিনেপ্লেক্সের চেয়ারম্যান মাহবুব রহমান নিউজবাংলাকে জানান, রাজধানীর বাইরে কুমিল্লা, রাজশাহী এবং বগুড়ায় সিনেপ্লেক্সের শাখা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
যখন সারা দেশে সিঙ্গেল স্ক্রিন বন্ধ হচ্ছে, তখন মাল্টিপ্লেক্স বাড়ছে কেন?
এ ব্যাপারে স্টার সিনেপ্লেক্সের চেয়ারম্যান মাহবুব রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমত আমাদের পরিকল্পনাতেই ছিল যে আমরা সারা দেশে সিনেপ্লেক্স করব। মিরপুরে যে সিনেপ্লেক্সটি করা হয়েছে, তার পরিকল্পনা অনেক দিন আগের।
‘দ্বিতীয়ত, আমাদের কিছু হলেও কনটেন্ট আছে। আমরা বাংলা সিনেমার পাশাপাশি হলিউডের সিনেমা দেখাতে পারি। আমাদের সে ক্যাপাসিটি আছে। কিন্তু সিঙ্গল স্ক্রিনগুলোর সে ক্যাপাসিটি নাই। তারা সময়ের সঙ্গে নিজেদের আপগ্রেড করেনি।’
চলতি বছর আগস্টে মিরপুরে চালু হয়েছে রাজধানীর সিনেপ্লেক্স । ছবি: সংগৃহীত
স্টার সিনেপ্লেক্সে হলিউডের সিনেমা দেখাতে চাইলে বা দেশের বাইরের সিনেমা প্রদর্শন করতে চাইলে নিতে হয় সেন্সর ছাড়পত্র।
সেন্সর বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত দেশে বিদেশি ছবি মুক্তি পেয়েছে ২৬৪টি। একই সময়ে দেশি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে যথাক্রমে ২৮৮টি।
বিদেশি বা হলিউডের সিনেমা মুক্তির সংখ্যা একই থাকলেও বছরের পর বছর দেশি সিনেমার সংখ্যা কমেছে। ২০২০ সালে দেশে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হলে বছরের অনেকটা সময় ছিল সাধারণ ছুটির আওতায়। এ ছুটির মধ্যেও বিদেশি সিনেমা মুক্তি পাওয়া বন্ধ ছিল না।
মাহবুব রহমান আরও বলেন, ‘করোনার মধ্যে আমরা সবাই দিশেহারা। সিনেপ্লেক্সের যে কোনো ক্ষতি হয়নি তা কিন্তু না। বসুন্ধরা সিটির সবচেয়ে বড় হল যেটি (হল ৪), সেটি বন্ধ করে দিতে হয়েছে। কারণ সামর্থ্যে কুলাতে পারছিলাম না। সেটা আর চালু হচ্ছে না। আমরা হলিউড সিনেমা দেখাতে পারলেও আমাদের আরও কনটেন্ট প্রয়োজন।’
দেশের প্রযোজকরা তাদের ভালো ভালো সিনেমাগুলো মুক্তি দিচ্ছেন না। এমন অবস্থায় সিনেমা হলমালিকরা চান বলিউডের সিনেমা আনতে।
ভারতীয় সিনেমা আনতে চিঠি
প্রদর্শক সমিতির সভাপতি কাজী শোয়েব রশিদ, প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাশ এবং সিনিয়র সহসভাপতি মিয়া আলাউদ্দিন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি বেশ কিছু দিন আগে দেয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। চিঠিটি ১৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় গ্রহণ করেছে।
সেই চিঠিতে প্রদর্শক সমিতি চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ভারতীয় ছায়াছবি আমদানির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছে। সীমিত সংখ্যায়, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভারতীয় সিনেমা আমদানি ও প্রদর্শনের সুযোগ দিতে বলেছেন তারা।
ভারতীয় সিনেমা আমদানি করতে চায় চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি। ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সবশেষ বলা হয়েছে, সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় তিন বছরের জন্য প্রতিবছর ১০টি করে ভারতীয় ছবি আমদানি করতে দেয়া হোক।
স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ বিপণন কর্মকর্তা মেজবাউর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা বলে হলিউডি সিনেমা এবং নামকরা পরিচালক বা অভিনশিল্পীদের বাংলা সিনেমা একসঙ্গে চললে দর্শকরা বাংলা সিনেমাই বেশি দেখেন। কিছু হলিউডি সিনেমাও বেশি দর্শক দেখার রেকর্ড আছে। তবে বাংলা সিনেমার দর্শক বেশি।’
মাহবুব রহমানও জানান, সিনেমা হল টিকিয়ে রাখতে এখন উপমহাদেশের সিনেমা সহজে আমদানি করার সুযোগ করে দিতে হবে। তা না হলে সিনেমা হল বিশেষ করে সিঙ্গল স্ক্রিন টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাবে।