দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর পর স্কুলে ফিরল শিক্ষার্থীরা। রোববার দেশের স্কুল-কলেজ খুলে দিলে সকাল থেকেই একটা সাজ সাজ অবস্থা দেখা গেছে স্কুলগুলোতে।
রাজধানীর একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, ক্লাস চালু হওয়ায় শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উচ্ছ্বাস। তবে এ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে অভিভাবকের মধ্যে কিছু শঙ্কাও দেখা গেছে। বিদ্যালয় কৃর্তপক্ষ অভিভাবকদের অভয় দিয়ে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠানোর পরামর্শ দিচ্ছে।
সকাল থেকেই রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে দেখা গেছে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ভিড়। সময়ের আগে অনেকেই চলে যায় স্কুলের ফটকের সামনে।
সেখানে অভিভাবকদের সঙ্গে, আবার দীর্ঘদিন পর দেখা হওয়া সহপাঠীদের সঙ্গে গল্প করছে।
ফটক খুলে দেয়ার পর তারা গিয়ে নিজেদের আসনে বসে। তবে তাদের সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বসতে দেখা গেছে। সবার মুখেই ছিল মাস্ক।
রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও দেখা গেছে একই চিত্র। সেখানেও শিক্ষার্থীরা মাস্ক পরে ও অন্য সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাসে ফিরেছে।
ফুল দিয়ে শিক্ষার্থীদের বরণ করছেন শিক্ষকরা। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস
রাজধানীর বাড্ডার শাহাজাদপুর এলাকায় কয়েকটি স্কুল ঘুরে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের পদচারণ। সকাল থেকেই শিক্ষার্থীদের তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে স্কুলে আসতে দেখা গেছে।
স্কুলগুলোর ফটকে কোথায় কোথায় শিক্ষার্থীদের শরীরের তাপমাত্রা মেপে তারপর প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে। রাখা আছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার।
কয়েকটি স্কুলে দেখা গেছে, ফটকসহ ক্লাসরুমগুলোও সাজানো হয়েছে বাহারি রঙের বেলুনে।
শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস
দীর্ঘদিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পা রেখেই আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে শিক্ষার্থীরা। সবারই চোখে-মুখে ছিল খুশির ঝিলিক।
স্কুল প্রাঙ্গণ আবারও মুখরিত চিরচেনা সেই পরিবেশে। যেখানে শিক্ষার্থীরা আবার সশরীরে ক্লাসে অংশ নিচ্ছেন আর শিক্ষকরাও পাঠদান করছেন। এ নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার চোখে-মুখেই ছিল খুশির ঝিলিক। তবে এ আনন্দের সঙ্গে অভিভাবকদের আছে উদ্বেগও।
দীর্ঘদিন পর ক্লাসে ফিরে শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস। ছবি: নিউজবাংলা
শিক্ষার্থী বরণ
দীর্ঘ ১৭ মাস পর স্কুল খোলার প্রথম দিনে নানা উৎসব-আয়োজনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের বরণ করে নিতে দেখা গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে।
রাজধানীর একাধিক স্কুলে গিয়ে বেলুনসহ নানা উপকরণ দিয়ে সাজাতে দেখা গেছে। স্কুলে শিশু-কিশোররা যেন নির্ধারিত দূরত্ব বজায় রেখে অবস্থান করে, সেজন্য করিডোরে দাগ দিয়ে দেয়া হয়েছে।
উচ্ছ্বাস শিক্ষকদেরও
সশরীরে পাঠদান অংশ নিতে পেরে উচ্ছ্বসিত শিক্ষকরাও। তারা বলছেন, শিক্ষকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বোঝাপড়া। দীর্ঘ দিন পর এটি আবার শুরু হওয়ায় তারা খুবই আনন্দিত।
ইস্পাহানি গ্লার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাদেকা বেগম বলেন, ‘দীর্ঘ দিন পর সশরীরে পাঠদানে অংশ নিতে পেরে আমরা খুবই আনন্দিত। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাস নেয়ার জন্য আমরা সব ধরণের ব্যবস্থা করেছি। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাস্ক পরার বিষয়টি কঠোরভাবে নজরদারি করা হচ্ছে।’
স্কুলে আবার পাঠদান শুরু হওয়ায় খুশি বড় মগবাজার সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক সামসুননাহার বেগমও। তিনি বলেন, ‘শিশুদের খোলা হলে আবার মুখরিত হয়ে উঠল প্রিয় প্রাঙ্গন। শিক্ষার্থীদের মতো আমারও খুবই ভালো লাগছে।’
ইস্কাটন গার্ডেন উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক শফিউদ্দিন মিয়া মনে করেন, শিক্ষার্থী ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একদমই অচল। তিনি বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কমায় দীর্ঘ দিন পর স্কুল খুললো। একটা কথা চির সত্য তা হলো শিক্ষার্থী ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একদমই অচল। এই দুইয়ের সমন্বয় না থাকলে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো যায় না।
শাহনুরী মডেল স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক সাইদুর রহমান স্কুল খোলায় সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘দীর্ঘ দিন থেকে আমরা অনলাইনে ক্লাস নিয়েছি। কিন্তু সশরীরে পাঠদান করা সম্ভব হয়নি। আজ আবার আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাসে অংশ নিতে পারায় আমি খুবই আনন্দিত।’
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপাল কামরুন নাহার জানান, তারা সবধরনের নির্দেশনা মেনে ছাত্রীদের স্কুলে আসার ব্যবস্থা করেছেন। কোনভাবেই যেন স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত না হয় সেই বিষয়ে তিনি নিজে ও শিক্ষকেরা নজর রাখছেন।
তিনি বলেন, ‘সরকার থেকে যে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে তা সব নেয়া হয়েছে। যে রুটিন দেয়া হয়েছে সেই অনুযায়ী ক্লাস পরিচালনা করা হবে। প্রতিটি ক্লাসে এক বেঞ্চে একজন করে শিক্ষার্থী বসানো হয়েছে।’
শরীরের তাপমাত্রা মেপে স্কুলে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস
স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না অভিভাবকরা
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করোনা সংক্রমণ রোধে নানা ধরনের নিয়ম-কানুন মানা হলেও গেটের বাইরে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা জটলা তৈরি করছেন। সেখানে স্বাস্হবিধি মানা হচ্ছে না। রোববার রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের আগে তাপমাত্রা মাপা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার লাগানো, সারিবদ্ধ হয়ে ভেতরে প্রবেশ, সামাজিক দূরত্ব রেখে ক্লাস রুমে বসা, মাস্ক পরাসহ নানা ধরনের নিয়ম-কানুন মানা হচ্ছে। অথচ গেটের বাহিরে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে ভেতরে প্রবেশ করতে চেষ্টা করছেন। বিষয়টি নিয়ে বার বার স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিভাবকদের সতর্কও করছে।
গত ৫ সেপ্টেম্বর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে আসায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার ঘোষণা দেয় সরকার।
তখন জানানো হয়, সংক্রমণের হার দ্রুত কমছে। আর টিকাদান কার্যক্রমে গতি থাকায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দীপু মনি সে সময় বলেন, ‘যারা ২০২১ সালে এসএসসি-এইচএসসি আর আগামী বছরের এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার্থী তারা প্রতিদিন ক্লাসে আসবে। এ ছাড়া অন্যান্য ক্লাস এক দিন চলবে। একইভাবে প্রাথমিকের পঞ্চম শ্রেণি প্রতিদিন এবং অন্যান্য ক্লাস সপ্তাহে এক দিন চলবে।’
২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে করোনা সংক্রমণের প্রমাণ পাওয়ার পর ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এরপর দফায় দফায় বাড়ানো হয় ছুটির মেয়াদ। সর্বশেষ ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়ে।
মেডিক্যাল, ডেন্টাল ও নার্সিংবিষয়ক সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীরে ক্লাস চালু হবে আগামীকাল থেকে।
সম্প্রতি জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দেশের ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের ভাষ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যত বেশি সময় বন্ধ থাকবে, ততই বাড়বে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা।