টানা দুই মেয়াদে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্বে রয়েছেন বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আরিফুল হক চৌধুরী। দায়িত্ব পালনের সময় সিলেটে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও মন্ত্রীদের সঙ্গে তার সখ্য বিভিন্ন সময় আলোচনায় আসে।
ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সখ্যের কারণে ত্বরান্বিত হয়েছে সিলেট নগরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। সরকার থেকে এসেছে বড় বরাদ্দ। তবে বিরোধীদলীয় মেয়রের সঙ্গে সরকারদলীয় মন্ত্রী-নেতাদের এই ঘনিষ্ঠতায় আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মধ্যে শুরু থেকেই ক্ষোভ ছিল।
এ ক্ষোভের মধ্যেও সিলেট-১ আসনের সাবেক সাংসদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং বর্তমান সাংসদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে মেয়র আরিফের সম্পর্কে ভাটা পড়েনি। বরং মুহিত পরিবারের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন আরিফ। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদেরও কখনো এই মেয়রের সমালোচনায় দেখা যায়নি। আবার ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে সখ্যের কারণে নিজ দলে বিভিন্ন সময়ে সমালোচিত হয়েছেন আরিফ।
তবে মেয়র পদে টানা দ্বিতীয় মেয়াদের মাঝামাঝি সময়ে এসে ক্ষমতাসীন দলের তোপের মুখে পড়েছেন আরিফুল হক চৌধুরী। সম্প্রতি আরিফের এক বক্তব্যকে ঘিরে আওয়ামী লীগের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়।
এক অনুষ্ঠানে মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের গন্ডারের সঙ্গে তুলনা করেছেন, এমন অভিযোগ তুলে প্রতিবাদে সরব হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগ নেতারা। অন্যদিকে মেয়র অনুসারীরা একে ‘সত্য বয়ান’ বলে প্রচার করছেন।
বিএনপির আরিফুল হক ও আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন পাল্টাপাল্টি বক্তব্যকে অনেকেই আগামী সিটি নির্বাচনের আগাম লড়াই হিসেবে দেখছেন।
ঘটনার শুরু গত ৫ সেপ্টেম্বর সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের ১২তম মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠান থেকে। মৌলভীবাজারে সাইফুর রহমানের স্মরণসভায় সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বক্তব্য দেন।
ওই বক্তব্যের একপর্যায়ে মেয়র কারও নাম উল্লেখ না করে বলেন, ‘এই (সিলেট) অঞ্চলে যে স্মৃতিগুলো থেকে সাইফুর রহমানের নাম মুছে ফেলে দেয়া হয়েছে, তেমনি আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়ার নামও মুছে ফেলা হয়। আমাদের নেতা শহীদ জিয়াউর রহমানের নাম মুছে ফেলা হয়েছে। মুছে ফেললেও মানুষের মুখ থেকে নতুন নাম উচ্চারণ করাতে পারছে না।
‘মানুষ এখনও জানে সেই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সেই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, আজকে যেটা গর্ব করে বলেন, বিভাগীয় স্টেডিয়াম, যা-ই বলেন না কেন, এই অঞ্চলে বলতে গেলে অনেক বলতে হবে। আমি শুধু বলব, এদের সম্পর্কে কিছু বলে লাভ নেই। এদের ধিক্কার দেয়া ছাড়া কোনো বক্তব্য আমার মুখেও আসতেছে না। এদের চামড়া এত শক্ত হয়েছে যে, গন্ডারের চামড়া থেকেও বেশি। এদের গায়েও কিছু লাগে না।’
আরিফুল হক বক্তৃতায় আরও বলেন, ‘ঘুম থেকে উঠে তারা বিএনপি পরিবারের ওপর, শহীদ জিয়া থেকে শুরু করে বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান পর্যন্ত শেষ হয়। তসবির মতো জপতে থাকে। তাদের আর কোনো কাজ নেই। তারা সরকারে বসে ঘুমিয়ে আছে, ঘুম থেকে উঠে কী বলব, ভাষায় বলার মতো নেই। তারা শেষ পর্যন্ত সব ধ্বংস করে দিয়ে এখন লাগছে পদকটা নিয়ে টানাটানি। এদের যে কী দশা হবে আল্লাহ জানে। আসলে তারা ভীত।’
মেয়র আরিফের এই বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। প্রথমে মধ্যম সারির নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করলেও পরে যুক্ত হন শীর্ষ নেতারাও।
তারা মেয়রের বক্তব্যকে উসকানিমূলক ও কটূক্তি দাবি করে তা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন।
আরিফের এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে শুক্রবার সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এসব অসৌজন্যমূলক, অশালীন বক্তব্য প্রত্যাহার করার আহ্বান জানাচ্ছি। মেয়র সাহেব, আপনি ভুলে যাবেন না, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়রের চেয়ারে বসে আছেন এবং ইচ্ছামতো সরকারের টাকার অপচয় করছেন।’
সিলেটের উন্নয়নে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের প্রচেষ্টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় সিটি করপোরেশনে শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ এসেছে উল্লেখ করে আসাদ উদ্দিন লিখেছেন, ‘আপনি (মেয়র) সেই টাকায় পছন্দের ঠিকাদারকে দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে যা ইচ্ছা তা করে যাচ্ছেন। এত গাফিলতি এবং অনিয়মের পরেও সরকার উন্নয়নের স্বার্থে দেশের একসময়ের শীর্ষ তালিকাভুক্ত দুর্নীতিবাজ হওয়া সত্ত্বেও আপনার বরাদ্দ বন্ধ করেনি, কিংবা সিলেটের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরাও কোনো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেনি। কারণ, আওয়ামী লীগ প্রতিহিংসার রাজনীতি করে না; বরং সম্প্রীতির রাজনীতিতে বিশ্বাসী। দুঃখ হয়, এত সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পরও আপনি আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের গন্ডারের চামড়ার সঙ্গে তুলনা করলেন। আর কী পেলে আপনার মধ্যে সামান্যতম কৃতজ্ঞতাবোধ জন্ম নেবে?’
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন শনিবার ফেসবুকে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান।
সিলেট আওয়ামী লীগের মধ্যম সারির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, গত জোট সরকারের আমলে আরিফুল হক চৌধুরী ছিলেন মহানগর বিএনপির সভাপতি ও নগরের একটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। সে সময়কার অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ার কারণে সিলেটজুড়ে ছিল তার দোর্দণ্ড প্রতাপ। তৎকালীন আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র প্রয়াত বদরউদ্দিন আহমদকে পাশ কাটিয়ে আরিফের মাধ্যমেই সিলেটের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত করতেন সাইফুর। এ সময় ব্যাপক দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেন আরিফ। পরবর্তী সময়ে সেনা-সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় এলে দেশে শীর্ষ ৫০ দুর্নীতিবাজের তালিকায় উঠে আসে আরিফের নাম।
তারা অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দলের সুযোগে আরিফুল হক বারবার মেয়র নির্বাচিত হচ্ছেন। তিনি এখন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও শীর্ষ নেতাদের প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছেন। তাদের প্রশ্রয়েই সরকারের টাকায় উন্নয়ন করে নিজের নামে প্রচার করছেন। আর সরকার ও আওয়ামী লীগের নামে বদনাম করে বেড়াচ্ছেন।
মেয়র আরিফের এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান শনিবার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আরিফুল হকের বক্তব্য শিষ্টাচারবহির্ভূত। সিলেটের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে এমন বক্তব্য বেমানান। আমরা রাজনৈতিকভাবে তার বক্তব্যের জবাব দেব।’
আরিফ যখন যাকে খুশি করে চললে নিজের সুবিধা হয়, তখন তাকে তোষামোদ করে চলেন, এমন মন্তব্য করে নাসির বলেন, এখন হয়তো তার দলকে খুশি করার প্রয়োজন, তাই এমন বক্তব্য দিচ্ছেন। আবার মন্ত্রীকে খুশি করার প্রয়োজন হলে বক্তব্য উল্টে দেবেন।
নাসির বলেন, ‘আমাদের দলের মধ্যে যারা আরিফকে প্রশ্রয় দেন, আশা করি তারা এখন সতর্ক হবেন এবং তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া থেকে বিরত থাকবেন।’
এ প্রসঙ্গে সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমার কী বক্তব্য কীভাবে ছড়িয়েছে, বক্তব্য ঠিক আছে কি না, আমি এখনো তা দেখিনি। সব দেখেশুনে মন্তব্য করতে হবে।’