প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেডিক্যাল সহকারী তমা (ছদ্মনাম)। বাংলাদেশে বিভিন্ন হাসপাতালে চাকরির চেষ্টা করছিলেন। এরই মাঝে একটি ট্রাভেল এজেন্সির খোঁজ পান। জানতে পারলেন ভালো বেতনে মধ্যপ্রাচ্যের হাসপাতালে চাকরির ব্যবস্থা করে দেয় তারা।
তমা যোগাযোগ করেন ট্রাভেল এজেন্সির মালিক আজাদ রহমান খানের সঙ্গে। তিনি তমাকে জানান, ইরাকের একটি হাসপাতালের বড় একজন বাংলাদেশি চিকিৎসক তাকে ফোন করবেন এবং তিনিই তমাকে ইরাকে নিয়ে চাকরি দেবেন।
কথা অনুযায়ী তমাকে ফোন করেন লিটন মিয়া নামের একজন কথিত ডাক্তার। কিছুদিন কথা বলে লিটন তমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন।
তমা লিটনকে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললে ২০১৭ সালে লিটন ১০ দিনের ছুটিতে দেশে এসে পারিবারিকভাবে তমাকে বিয়ে করেন।
এরপরই তমাকে ট্যুরিস্ট ভিসায় তমাকে ইরাকে নিয়ে যান লিটন। কিন্তু ইরাকে পৌঁছে লিটনের কাছে আরো অনেক বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীকে জিম্মি থাকতে দেখে সন্দেহ হয় তমার। তিনি আরও খোঁজ নিয়ে বুঝতে পারেন লিটন তাকে পাচারের উদ্দেশে বিয়ে করে নিয়ে এসেছেন।
এরপর তমা কৌশলে নিজের পাসপোর্ট নিয়ে লিটনের বাসা থেকে পালিয়ে যান। পরে তিনি বাগদাদের একটি হাসপাতালে নার্স হিসেবে যোগ দেন। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর নিজের বেতনের টাকা দিয়ে বিমানের টিকিট কেটে দেশে ফেরেন।
আরেক একজন ভুক্তভোগী আয়েশা (ছদ্মনাম) আরও কিছু বাংলাদেশি নার্সদের সঙ্গে লিটনের মাধ্যমে ২০১৮ সালে ইরাকে যান। সেখানে আরও ১০ থেকে ১৫ জন বাংলাদেশি নারীদের সাথে একটি বড় কক্ষে রাখা হয় তাকে। ওই নারীদের সঙ্গে লিটন অনৈতিক কাজ করতেন এরপর তাদের ইরাকের বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দিতেন।
ইরাকে নারী পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার দুই জনকে শনিবার র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে হাজির করা হয়
আয়েশা জানান, তাকে তিনজনের কাছে বিক্রি করে দেন লিটন। ওই তিনজন ব্যক্তি তাকে আটকে রেখে অনৈতিক কাজে বাধ্য করত। এক সময় একজনের মাধ্যমে ওই জিম্মিদ্দশা থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসেন।
দেশে ফিরে আয়েশা ও তমা লিটনের মানব পাচার চক্র সম্পর্কে র্যাবের কাছে অভিযোগ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় লিটন মিয়া ও আজাদ রহমান খানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৪।
শনিবার সকালে রাজধানী মিরপুর ও উত্তরা এলকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু পাসপোর্ট, জাল সিল, জাল টাকা, ভূয়া পরিচয়পত্র, বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম কার্ড, চেকবই সহ ইয়াবা ও বিয়ার উদ্ধার করা হয়।
বিকেলে কারওয়ান বাজারের মিডিয়া সেন্টারে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন একটি সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানান। তিনি বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃতরা মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। এই চক্রের মূল হোতা লিটন মিয়া। তার এই চক্রে ২০ জনের বেশি সদস্য রয়েছে, এদের মধ্যে বাংলাদেশে ১০-১৫ জন ও ইরাকে আরো ৫ থেকে ৭ জন সদস্য রয়েছে।
খন্দকার মঈন বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সদের চাহিদাকে কেন্দ্র করে চক্রটি বাংলাদেশের নার্সিং পেশার নারীদের পাচারের জন্য টার্গেট করে। তারা ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩০ থেকে ৩৫ জন নারীকে এভাবে ইরাকে পাচার করেছে।’
র্যাবের মুখপাত্র বলেন, ‘লিটনের সহযোগী আজাদ রাহমানের একটি ট্রাভেল এজেন্সি আছে। সেই এজেন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নার্সদের বিদেশে চাকরি দেয়ার নাম করে প্রলোভন দেখানো হত।
‘প্রলুব্ধ হয়ে যারা আগ্রহ প্রকাশ করতেন তাদের লিটনের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতেন আজাদ। লিটন ইরাকে থাকতেন এবং নিজেকে সেই দেশের একটি স্বনামধন্য হাসপাতালের চিকিৎসক পরিচয় দিতেন।
‘এরপর লিটন ইরাকে চাকরি প্রত্যাশীদের সঙ্গে টেলিফোনে সখ্য গড়ে তুলতেন ও তাদের বিয়ের প্রস্তাব দিতেন। ইরাকে থেকে টেলিফোনে লিটন তাদের বিয়ে করে অথবা সরাসরি দেশে এসে স্বল্প সময়ে বিয়ে করে ওই নারীদের ইরাকে নিয়ে যেতেন।
‘সেখানে ওই নারীদের বিভিন্ন সেইফ হাউজে রাখা হতো এবং সেখান থেকে তাদের অনৈতিক উদ্দেশ্যে অন্যদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হকো।’
এভাবে লিটন নিজের ডাক্তার পরিচয় দিয়ে অন্তত ৬ জন নারীকে বিয়ে করে ইরাকে নিয়ে বিক্রি করেছেন বলে তথ্য পেয়েছে র্যাব।
আর ২০১৩ সাল থেকে এই চক্র অন্তত ৩৫ জন নারীকে মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করেছে বলেও তাদের কাছে অভিযোগ এসেছে।
তারা পাচার হওয়া নারীদের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা করে নিত এবং ইরাকে ১৫ থেকে ২০ হাজার দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দিত।
খন্দকার মঈন বলেন, ‘নারীদের পাশাপাশি চক্রটি প্রায় ২৫০ জন যুবককেও বিদেশে পাঠানোর নামে তাদের জিম্মি করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। তারা ৫ লাখ টাকা চুক্তিতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের চাকরি দিবার কথা বলে তাদের ইরাকে পাঠিয়ে আটকে রেখে জিম্মি করে দেশের স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায় করত।’
বিয়ে করে ইরাকে নারী পাচারের বিষয়ে ব্রিফিং করছেন র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন
নারী-পুরুষ সবাইকে তারা ভ্রমণ ভিসার মাধ্যমে ইরাকে পাচার করত বলে জানান খন্দকার আল মঈন।
লিটন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তিনি ঢাকার একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে মেডিক্যাল সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। সেখানে দুর্নীতি ও অনৈতিক কাজের জন্য তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এরপর ২০১৩ সালে লিটন ইরাকে চলে যান। সেখানে ভুয়া ডাক্তার পরিচয় দিয়ে আজাদ ও মেরাজ নামে দুই বাংলাদেশি ব্যক্তির সহযোগিতায় এই পাচার কাজ শুরু করেন।’
লিটন মানবপাচারের অভিযোগে ইরাকে দুইবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। ২০১৯ সালে তিনি বাধ্য হয়ে দেশে ফিরে আসেন। দেশেও তার নামে একাধিক মামলা রয়েছে।
ভুক্তভোগীরা ফিরে এসে ইরাকে আরো নারী ও যুবকদের জিম্মিদশায় থাকার কথা জানিয়েছেন। তাদের উদ্ধারের জন্য সব তথ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জানানো হবে বলে জানান খন্দকার আল মঈন।