ভিডিও স্ট্রিমিং ওয়েবসাইট নেটফ্লিক্সের ফরাসি একটি চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক সম্পর্কে ‘অসম্মানজনক ও অবমাননাকর’ সংলাপ সরানোর ব্যাপারে এবার সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত নিয়ে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্যটি অপসারণ করা; অপসারণ করা না হলে বাংলাদেশে নেটফ্লিক্সে এই চলচ্চিত্রটি প্রচার বন্ধ রাখার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়।
গত ২ সেপ্টেম্বর আলাদা চিঠিতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাইফুল ইসলাম এই নির্দেশ দিয়েছেন।
দুই চিঠিতিই বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বিনোদনধর্মী প্রতিষ্ঠান নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া ডেভিড শ্যারন পরিচালিত ফ্রেঞ্চ ভাষার চলচ্চিত্র দি লাস্ট মার্সেনারি তে বাংলাদেশি পণ্য নিয়ে ‘আপত্তিকর’ সংলাপ রয়েছে। সিনেমার একটি দৃশ্যে একজন অভিনয়শিল্পী বলছেন, ‘হ্যাঁ, এটা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট (Ah, yes. Bulletproof tuxedo)’। জবাবে আরেকজন বলেন, ‘এটা মেড ইন ফ্রান্স। তবে যদি এটি বাংলাদেশ থেকে আসে, তাহলে আমি ধ্বংস হয়ে যাব (Made in France. If it was from Bangladesh, I,d be gone.)।
বিটিআরসির চেয়ারম্যানকে পাঠানো চিঠিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যটি সরিয়ে নিতে; সরিয়ে না নেয়া হলে বাংলাদেশে নেটফ্লিক্সে এই চলচ্চিত্রটি প্রচার বন্ধ রাখার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।
অন্যদিকে পররাষ্ট্র সচিবকে লেখা চিঠিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন/দূতাবাসের মাধ্যমে দি লাস্ট মার্সেনারি চলচ্চিত্র থেকে আপত্তিকর মন্তব্যটি অপসারণ করা; অপসারণ করা না হলে নেটফ্লিক্সে প্রচার বন্ধ রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।
৩০ জুলাই নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে ভ্যান ড্যাম অভিনীত সিনেমা দি লাস্ট মার্সেনারি । সিনেমাটি এখন ওই ওটিটি প্ল্যাটফর্মে জনপ্রিয়তার তালিকায় সেরা দশে রয়েছে। দর্শকপ্রিয় হওয়া সিনেমাটির একটি সংলাপে বাংলাদেশি পণ্যবিরোধী প্রচারণার অভিযোগ উঠেছে।
অনেকেই মন্তব্য করেছেন, ডেভিড শ্যারন পরিচালিত ফ্রেঞ্চ ভাষার এই সিনেমায় বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যকে নিম্নমানের বলে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
সিনেমাটির ১ ঘণ্টা ৪১ মিনিটে শুরু হওয়া দৃশ্যে দেখা যায়, একজন অভিনয়শিল্পী বলছেন, ‘হ্যাঁ, এটা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট (Ah, yes. Bulletproof tuxedo)’।
উত্তরে আরেকজন বলেন, ‘এটা মেড ইন ফ্রান্স। তবে এটি বাংলাদেশ থেকে আসলে আমি শেষ হয়ে যেতাম (Made in France. If it was from Bangladesh, I,d be gone.)।
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক সম্পর্কে ‘অসম্মানজনক ও অবমাননাকর’ এই সংলাপ সরানোর আগ পর্যন্ত দি লাস্ট মার্সেনারি সিনেমাটির সম্প্রচার বন্ধের আহ্বান জানিয়ে নেটফ্লিক্সকে ৭ আগস্ট চিঠি দিয়েছিলেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।
এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিবকেও চিঠি দিয়েছিলেন বিজিএমইএ সভাপতি।
সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতেই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় বিটিআরসি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে।
একই বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে গত ৯ আগস্ট চলচ্চিত্রটির পরিচালক, ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূতকেও চিঠি লিখেছিলেন তিনি।
কিন্তু এক মাস পার হয়ে গেলেও এখনও চলচ্চিত্রটি থেকে ওই সংলাপ সরানো হয়নি বা কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এ কারণেই হতাশা প্রকাশ করে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে গত ৮ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে আবারও আলাদা আলাদা চিঠি লিখেছিলেন ফারুক হাসান। চিঠি দুটির ভাষা একই ছিল।
সর্বশেষ চিঠিতে ফারুক হাসান লিখেছিলেন, ‘ব্যবসা, অর্থনীতি আর সামাজিক বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যকার সম্পর্ক কয়েক দশক ধরেই বিরাজমান। আপনার এ সমর্থন দেয়ার বিষয়টিকে সামনে রেখে ২০২১ সালের ৭ আগস্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপনাকে চিঠি দিয়েছিলাম। একটি বিষয়, যা কি না বাংলাদেশিদের হৃদয়কে ‘ভেঙেচুরে’দিয়েছে, চিঠিতে সেটি উপস্থাপন করেছিলাম।
চিঠিতে ফারুক হাসান বলেছেন, ‘মেড ইন বাংলাদেশ শুধুমাত্র যে আমাদের জাতির জন্য গর্বের বিষয়, সেটি নয়; এর বিস্তৃতি আরও বেশি। এর মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে আমাদের গৌরবময় আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরের ধারাবাহিকতায় পোশাকশিল্প আজ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গত তিন দশক ধরে অর্থনীতির অন্যান্য খাতগুলোতেও এ শিল্পের সরব পদচারণা প্রশংসিত হয়েছে।’
চিঠিতে তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমরা আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পকে সব দিক থেকে নিরাপদ, সুরক্ষিত, সবুজ এবং টেকসই করার জন্য সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। সুরক্ষার জন্য সব নিরাপত্তা মান নিশ্চিত করেছি এবং সেরা ব্যবসায়িক অনুশীলনগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। করোনা মহামারির মধ্যে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, আন্তর্জাতিক বাজার যখন তার স্বাভাবিক গতি ফিরে পাওয়ার পথে রয়েছে, তখন আমাদের নিজস্ব ব্র্যান্ড নিয়ে এ ধরনের অযৌক্তিক ও আপত্তিকর মন্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
চিঠিতে বলা হয়, ‘এর আগে আমরা নেটফ্লিক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ওই চলচ্চিত্রের পরিচালককে আমাদের এ উদ্বেগের বিষয়টি জানিয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, তাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া পাইনি। চলচ্চিত্রটি এখনও নেটফ্লিক্সের প্লে লিস্টে রয়েছে এবং চলচ্চিত্র থেকে সেই আপত্তিকর সংলাপগুলোও সরিয়ে ফেলা হয়নি।
‘বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য আমাদের ব্যথিত করেছে। আমরা এর নিন্দা জানাই এবং আপনার বেঞ্চের মাধ্যমে ফরাসি সরকার ও চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের প্রশ্নবিদ্ধ সংলাপটি অনতিবিলম্বে অপসারণের জন্য পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।’
ফারুক হাসান বলেন, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা মানবাধিকার আইন ১৯৯৮ এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। তবে এটি অবশ্যই দায়িত্বশীলতার সঙ্গে পালন করতে হবে। এরপরও জনপ্রতিনিধিরা মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার সীমাবদ্ধ রাখার ক্ষমতা রাখেন, যদি কি না সেটি কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত খ্যাতিকে বিনষ্ট করে। এরপরও বলা যায় যে, চলচ্চিত্রে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ নিয়ে যে মন্তব্য আছে, সেটি পুরোপুরি ভুল। কারণ, বাংলাদেশ বুলেট প্রুফ জ্যাকেট তৈরি করে না। গত চার দশক ধরে আমরা যে পোশাক তৈরি করছি, সেটি বিশ্বব্যাপী ক্রেতা ও ভোক্তাদের আস্থা অর্জন করেছে তার গুণগত মান ও প্রতিযোগিতামূলক মূল্য দিয়ে।’
চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘এ কারণে বিজিএমইএ ও পোশাক শিল্প পরিবারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন এবং আপনার (রাষ্ট্রদূত) মাধ্যমে ফরাসি কর্তৃপক্ষকে চলচ্চিত্রটি থেকে প্রশ্নবিদ্ধ সংলাপটি সরিয়ে নেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।’