চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়ে সরকারের আপত্তির কথা শোনা গেলেও, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে চুক্তিতে নিয়োগ দেয়া অব্যাহত রয়েছে। সরকার বলছে, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেও চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন ও প্রশাসনকে দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার স্বার্থেই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদে এ পদ্ধতিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
যারা অপরিহার্য, যাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা দিয়ে সরকার তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ করতে চায়, তাদেরকে এ পদ্ধতিতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে বলে দাবি করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
তবে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা মনে করেন, এ ধরনের নিয়োগের ফলে প্রশাসনের অনেক যোগ্য কর্মকর্তা বঞ্চিত হন। এ চর্চার কারণে প্রশাসনে তৈরি হতে পারে বিশৃঙ্খলা।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নীতি অনুযায়ী, যারা যোগ্য, তাদের প্রমোশন নিয়মিত হয় এবং সে অনুযায়ী পদায়ন হয়। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ কমানো এবং সেই নীতির ওপর আমরা এখনও চলমান আছি।’
এ মুহূর্তে প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে চলছে। এ ছাড়া সরকারের আরও ১৩ গুরুত্বপূর্ণ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
নিয়ম মেনে সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়ার বিধান চালু রয়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘এরপরেও আমাদের দু-একটি ক্ষেত্রে স্পেশালাইজেশন আছে। যে লোকটি ওই ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তার অনেক অভিজ্ঞতা আছে, যেমন আমাদের ক্যাবিনেট সেক্রেটারি সাহেব, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছেন।’
মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে দায়িত্বরত খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি অত্যন্ত ভাইটাল আমাদের জন্য। পদ্মাসেতুর প্রথম থেকে তিনি জড়িত ছিলেন। অনেকগুলো প্রকল্পের সঙ্গে তার যে অভিজ্ঞতা, তার যে অবদান ছিল, অনেকগুলো বিষয় চিন্তাভাবনা করে কিন্তু আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিসিশন নিয়েছেন।’
চলমান বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার প্রয়োজনীয়তা ছিল বলে মনে করেন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।
তিনি বলেন, ‘কোভিড সিচুয়েশনে আমাদের যেভাবে কাজ করতে হয়েছে, যে টিমটা কাজ করছে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে, তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পাশে থেকে নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করছেন।’
জনগণের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণেও কিছু দক্ষ লোককে সরকারের প্রয়োজন বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সামনে রূপকল্প আছে, আমাদের নির্বাচনি ইশতেহার আছে, আমাদের এসডিজি গোলগুলো অ্যাচিভ করার বিষয় রয়েছে ২০৩০ এর মধ্যে, ২০৪১-এ রূপকল্প আছে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ, ২০২৪ সালের মধ্যে কিছু পরিকল্পনা রয়েছে, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ।’
নগরবাসীকে যানজট থেকে মুক্তি দিতে চলমান মেট্রোরেলের ক্ষেত্রেও কয়েকজন প্রকৌশলীকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে জানান ফরহাদ হোসেন।
তিনি বলেন, ‘এদের যে স্পেশালাইজেশন, তাদের কোনো বিকল্প এখন নেই। এই কাজগুলো করার ক্ষেত্রে, এই প্রকল্পগুলো শেষ করার ক্ষেত্রে তাদের সমকক্ষ নেই।
‘সে ক্ষেত্রে প্রজেক্টগুলোকে খুব দ্রুত শেষ করার জন্য, অত্যন্ত দক্ষতা থাকার কারণে তাদেরকে কিন্তু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন।’
তবে সেই সংখ্যা খুব বেশি নয় বলে দাবি করেন প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অফিসারদের প্রমোশন বা পদায়ন বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সামারি পাঠিয়ে থাকি। সেটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিবেচনা করেন শুধুমাত্র যেখানে এসেনশিয়াল সেখানে। তা ছাড়া আমরা সবসময় জোর দিচ্ছি যে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ যাতে না হয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা দেয়া আছে।’
কারও কারও ক্ষেত্রে একাধিকবার চুক্তি নবায়ন হওয়ার উদাহরণ আছে জানানো হলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘একটা হচ্ছে টেকনিক্যাল বিষয়। তার যে নলেজটা, টেকনিক্যাল সাবজেক্টগুলো খুবই ডেলিকেট বিষয়। অনেক জায়গায় আমরা কিছু প্রফেসরকে দিয়েছি পড়ানোর জন্য, উনি ছাড়া ওই বিষয়ে অন্য কেউ নেই। আবার দেখা যাচ্ছে যে, মেট্রোরেলের ক্ষেত্রে ওনাদের টেকনিক্যাল নলেজ যেটা আছে, তাদের সমকক্ষ কেউ নেই। ওইরকম আমাদের কিছু নিয়ম আছে, তাদের আমরা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে পারি।’
খুব জরুরি ছাড়া চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হচ্ছে না জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘যারা অপরিহার্য, বিচার-বিশ্লেষণ করে তাদের দেয়া হচ্ছে। যার মাধ্যমে সরকার উপকৃত হবে, উন্নত দেশ গড়ার জন্য যে মেগা প্রকল্পগুলো আছে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ যেগুলো আছে, সেগুলো যথাসময়ে সম্পন্ন করার জন্য যাদের দক্ষতা বা অবদান দরকার, তাদের রাখা হচ্ছে।’
বর্তমানে ১৫ জন কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আছেন। কমানোর কোনো পরিকল্পনা আছে কী-না জানতে চাওয়া হয় প্রতিমন্ত্রীর কাছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের কিন্তু মেধাটাকে ব্যবহার করতে হবে দেশের প্রয়োজনে। যে যেখানে দক্ষ, সেই মানুষটিকে সেখানে প্রয়োজন। অন্যান্য দেশে কী হচ্ছে, সেটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। সিঙ্গাপুর ২০ শতাংশ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়। ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হতে পারে, অথবা আউটসোর্সিং করে। প্রতিটি দেশে এমন চালু আছে।’
বাংলাদেশে সরকারি চাকুরেরা ৫৯ বছর বয়সে অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে (এলপিআর) যান। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বয়সসীমা নিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘৫৯ বছর পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তারা কাজ করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বিচারকরা কাজ করতে পারেন ৬৫ বছর পর্যন্ত। সে ক্ষেত্রে ৬৫ বছর পর্যন্ত আমাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া যেতে পারে, দেয়া যায়।’
বিষয়টি নিয়ে বিশদ মন্তব্য করতে রাজি হননি সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। তবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ধারা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. আখতার হোসেনের যুক্তি, মহামারির সময়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হতে পারে। তবে স্বাভাবিক সময়ে সেটা করা অনুচিত।
তিনি বলেন, ‘এখানে দুটো বিষয় আছে। কোভিডকালে একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে দেশ চলছে। এর প্রভাব প্রশাসনেও পড়েছে। সেই কঠিন সময়টা পার করার জন্য এই সময়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দোষের কিছু নয়।’
অধ্যাপক আখতার বলেন, ‘তবে সাধারণ সময়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ অনুচিত। তাতে প্রশাসনে সুযোগের অপেক্ষায় থাকা অনেকে কর্মকর্তারা বঞ্চিত হয়।’