সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, প্রতিবন্ধী বা বিধবা নন এমন মানুষের নাম ওঠায় হালনাগাদ হওয়া তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন দুই হাজারের বেশি ভাতাভোগী।
তাদের অভিযোগ, সমাজসেবা কার্যালয়ের অসাধু কর্মচারীরা এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত।
কাজীপুরের সোনামুখী গ্রামের রোকেয়া খাতুন জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। তার বাবা হাবিবুর রহমান নিউজবাংলাকে জানান, ২০১০ সাল থেকে মেয়ের জন্য নিয়মিতই প্রতিবন্ধী ভাতা পেতেন। ৯ মাস ধরে বন্ধ সেই ভাতা। খোঁজ নিতে গেলে জানতে পারেন, মৃত দেখিয়ে তার মেয়ের নাম নতুন তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।
হাবিবুর বলেন, ‘আমি সমাজসেবা অফিসে গেলে ফরিদা ইয়াসমিন আমার মেয়ের ভাতার বইটি নিয়ে নেন। আমি বারবার বলি, আমার মেয়ে বেঁচে আছে, কিন্তু তিনি কোনো কথা না শুনে বইটি টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দেন। বইটি ফেরত চাইলে তিনি জানান, বই কোথায় আছে জানি না।’
হাবিবুর আক্ষেপ করে বলেন, ‘এই ভাতার টাকা দিয়ে আমার প্রতিবন্ধী মেয়ের জন্য খাবার আর ওষুধ কিনতাম। আমার মতো গরিবের হক ওরা মাইরা খাইতাছে, আল্লাহ ওদের হক উঠায় নিবো।’
কাজীপুর ও চৌহালী উপজেলায় ২০২০-২১ অর্থবছরে শতভাগ বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীদের ভাতা দেয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। সেই লক্ষ্যে নতুন আবেদনসহ আগের তালিকা হালনাগাদ শুরু করা হয়।
তালিকায় নাম উঠাতে কাজীপুর উপজেলার ১৭ হাজার ৯৫৬টি নতুন আবেদন জমা পড়ে। যাচাই-বাছাই শেষে ১২ হাজার ২৭৪ বিধবা, বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধীকে নতুন তালিকায় যুক্ত করে মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস ‘নগদ’-এর মাধ্যমে ভাতা দেয়া শুরু হয়।
নতুন আবেদন ও পুরোনো তালিকা হালনাগাদের পর ২৬ হাজার ৬৪ জনের মধ্যে রোকেয়ার মতো ২ হাজারের বেশি ভাতাভোগীর নাম বাদ পড়েছে।
রৌহাবাড়ী গ্রামের ৯০ বছর বয়সী আব্দুল কাদের বলেন, ‘আমি ১৫ বছর ধরে বয়স্ক ভাতা পাই। কিন্তু গত তিন কিস্তি ধরে আমার মোবাইলে কোনো টাকা আসে না। অফিসে গেলে আমার কাছ থেকে বইটা নিয়ে নেয় ঠিক করে দেবে বলে। এরপর আর সেই বই ফেরত দেয় না। টাকাও দেয় না।
‘এই বয়সে সরকারের কয়টা টাকা দিয়ে ওষুধপত্র কিনে খাচ্ছিলাম। ওরা আমার টাকা মেরে খাচ্ছে। আমি শেখের বেটির (প্রধানমন্ত্রী) কাছে বিচার চাই।’
গাছাবাড়ী গ্রামের বিধবা মনি বেওয়ার স্বামী মারা গেছে ছয় বছর আগে। তিনি বিধবা ভাতা পাচ্ছিলেন পাঁচ বছর ধরে। এবারের তালিকায় তার নামও বাদ পড়েছে। ভাতা আর পাবেন কি না তা নিয়ে শঙ্কিত মনি।
প্রতিবন্ধী ভাতার নতুন তালিকায় নাম উঠেছে রৌহাবাড়ী গ্রামের মো. মোস্তফা ও তার স্ত্রীর। তারা দুজনই সম্পূর্ণ সুস্থ। মোস্তফা জানালেন, সমাজসেবা অফিসের ফিল্ড সুপারভাইজার শামসুর রহমানের প্রলোভনে পড়ে টাকার বিনিময়ে তিনি তালিকায় নাম তুলেছেন।
তিনি বলেন, ‘শামসুর রহমান বলছে, তাকে ১০ হাজার টাকা দিলে সে ও তার স্ত্রীকে দুইটা প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেবে। তাকে টাকা দেয়ার পর সে আমাকে দুইটা প্রতিবন্ধী কার্ড দিছে। আমরা দুই কিস্তি টাকাও পাইছি।’
একই গ্রামের মমতা খাতুনের স্বামী জীবিত থাকা সত্ত্বেও তাকে মৃত দেখিয়ে বিধবা ভাতা প্রদানের নতুন তালিকায় তার নাম তুলে দেয়া হয়েছে।
মেঘাই ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শামিম আহম্মেদ বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে ১৮ জনের নাম বাতিল হওয়ায় আমি আর বাড়িতে টিকতে পারছি না। প্রতিদিন সকালে এই অসহায় মানুষগুলা আমার বাড়িতে এসে কান্নাকাটি করে। আমি এর কোনো সমাধান দিতে পারছি না। সমাজসেবা অফিসের কিছু কর্মকর্তা এসব করেছে।’
এ বিষয়ে কাজীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাইজবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শওকত আলী নিউজবাংলাকে জানান, কীভাবে এই তালিকা করা হয়েছে তা জানা নেই। সমাজসেবা অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারণে হাজার দুয়েক ভাতাভোগী বঞ্চিত হচ্ছেন।
তিনি জানান, সরকার যেখানে শতভাগ ভাতা ঘোষণা করেছে, সেখানে কীভাবে ভাতা থেকে এই মানুষগুলো বঞ্চিত হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে জেলা প্রশাসককে জানানো হয়েছে।
তালিকায় কেন সুস্থ ও বিধবা নন এমন মানুষের নাম উঠেছে, তা জানতে চাইলে এই প্রতিবেদককে হুমকি দেন সমাজসেবা অফিসের ফিল্ড সুপারভাইজার শামসুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘আমার অফিসের বিষয়ে জবাব অফিসারকে দেব, কোনো সাংবাদিককে নয়। আপনি বেশি বুঝলে আপনার বিরুদ্ধে মামলা করে দেব। আমি টাকা নেই আর না নেই, সেটা আমার বসরা বুঝবে, আপনি কে?’
উপজেলা সমাজসেবা অফিসের অফিস সহকারী ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমি ঠিক করার জন্য কিছু কার্ড নিয়েছিলাম। সেগুলো আমার কাছেই আছে। কাজ শেষ না হওয়ায় তাদের ফেরত দেয়া হয়নি।’
অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন কাজীপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আলাউদ্দিন হোসেন।
তিনি বলেন, ‘ভুক্তভোগীদের বেশ কিছু লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এসব অভিযোগ সত্য হলে আমরা নতুন করে আবার তালিকা সংশোধন করব। আর অনিয়মের ঘটনায় অফিসের কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহিদ হাসান সিদ্দিকী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি দ্রুত তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে মোবাইলে নগদে টাকা পাঠানো নিয়ে অনেকের জটিলতা হয়েছে। অনেক ভাতাভোগীর মোবাইল নম্বর ঠিক না থাকায় টাকা অন্যত্র চলে গেছে বলেও অভিযোগ আছে। সবকিছুই খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’