ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের বারান্দায় কাতরাচ্ছেন শহরের কাঞ্চনপুর এলাকার ২০ বছর বয়সী যুবক ইমরান হোসেন। স্ত্রী লিপি খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে নিজ ঘরে গত ২৮ আগস্ট গলায় ফাঁস দিয়ে ‘আত্মহত্যার’ চেষ্টা করেন তিনি। তার স্ত্রীকে ওই দিনই মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। বিকেলে একসঙ্গে ঘুরে সন্ধ্যায় আত্মহননের চেষ্টার কারণ অজানা পরিবারের।
প্রেমের স্বীকৃতি না পেয়ে ১৩ আগস্ট এক রশিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন মহেশপুর উপজেলার চাপাতলা গ্রামের আবু সাইদ ও সোহনা খাতুন। হরিণাকুন্ডু উপজেলার বেলতলা গ্রামে ২২ আগস্ট দুপুরে পারিবারিক কলহের কারণে সদ্যবিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন রাহিন ইসলাম। হাসপাতালে নেয়ার পর প্রথমে স্ত্রী আঁখি খাতুন ও পরে মৃত্যু হয় তার।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সাল থেকে চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ঝিনাইদহের ৬ উপজেলায় পারিবারিক কলহ, প্রেমে ব্যর্থতাসহ নানা কারণে আত্মহত্যা করেছেন ২ হাজার ৪১ জন নারী-পুরুষ। এ ছাড়া গেল দেড় বছরে এক রশিতে ঝুলে ৭টি আত্মহননের ঘটনা ঘটেছে।
এই প্রেক্ষাপটে শুক্রবার ঝিনাইদহসহ সারা দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য, ‘কাজের মাঝে জাগাই আশা।’
জেলা প্রশাসনের তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, ২০১৬ সালে জেলায় মোট আত্মহত্যা করেন ৩৮৮ জন। এর মধ্যে নারী ২১৯ ও পুরুষ ১৬৯ । ২০১৭ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২৪-এ। তাদের মধ্যে নারী ২৩৭ ও পুরুষ ১৮৭।
২০১৮ সালে আত্মহত্যা করেন ৩৯৬ জন; নারী ২২০ ও পুরুষ ১৭৬। ৩০৬ জন আত্মহত্যা করেন ২০১৯ সালে। এর মধ্যে নারী ১৭১ ও পুরুষ ১৩৫।
২০২০ সালে জেলায় আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ৩২০। এর মধ্যে নারী ১৬৯ ও পুরুষ ১৫১। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছেন ২০৬ জন। এর মধ্যে নারী ১০৮ ও পুরুষ ৯৮ ।
গত ৫ বছরের তথ্য যাচাই করে দেখা যায় নারীদের আত্মহত্যার সংখ্যা বেশি হলেও করোনাকালে বেড়েছে পুরুষের আত্মহত্যার হার।
তথ্য বলছে, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পুরুষের আত্মহত্যার হার ৪৩ থেকে ৪৪ ভাগ থাকলেও বর্তমানে তা ৪৭ ভাগের বেশি।
এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, লকডাউনে কর্মহীন আর পারিবারিক কলহ ও হতাশা থেকে এমন ঘটনা ঘটেছে।
এক সঙ্গে আত্মহত্যা প্রসঙ্গে জেলা সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সভাপতি সায়েদুল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পারিবারিক কলহ, মনোমালিন্য, প্রেমে ব্যর্থতাসহ নানা কারণে এক সঙ্গে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে।
‘সামাজিক এ সমস্যা দূর করতে সরকার, সমাজ ও পরিবারকে দায়িত্ব নিতে হবে। বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে সবাইকে সচেতন করতে হবে।’
আত্মহত্যা প্রতিরোধসংক্রান্ত নানা বিষয়ে কাজ করে ঝিনাইদহের সোসাইটি ফর ভলান্টারি অ্যাকটিভিটিজ (শোভা) নামের একটি সংগঠন।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘করোনাকালে আত্মহত্যার হার কমলেও বেড়েছে পুরুষের আত্মহত্যার হার। আয়-রোজগার না থাকায় হতাশা বা মানসিক অস্থিরতাই এর কারণ।’
জাহিদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে আরও বলেন, ‘ঝিনাইদহসহ এ অঞ্চলের মানুষ কিছুটা আবেগপ্রবণ, যে কারণে আত্মহত্যার হার এখানে বেশি। এ জেলার মানুষ কখনও আইলা দেখেনি, কখনও দেখেনি রাতের আঁধারে নিজেদের ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হতে।
‘দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ অনেকটা সংগ্রামী। কিন্তু এ এলাকার মানুষ প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগের মুখে পড়েনি। আবেগপ্রবণতা আত্মহত্যার প্রধান কারণগুলোর অন্যতম।’
ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক মজিবুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, দিবসটি ঘিরে তাদের আলাদা কোনো কর্মসূচি নেই। তবে মসজিদের ইমামদের বলা হয়েছে, তারা যেন শুক্রবার জুমার নামাজে আত্মহত্যার কুফল সম্পর্কে বয়ান দেন। এ ছাড়া বিভিন্ন এনজিওকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনার।