শুল্ক কমেছে। আমদানি বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। সরকারি গুদামে মজুত ১৬ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে। এরপরও প্রধান খাদ্যপণ্য চালের মূল্য বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না।
সরকারি হিসাবেই বৃহস্পতিবার রাজধানীর বাজারগুলোতে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাঝারি মানের চাল বিক্রি হয়েছে ৫৫ টাকা কেজিতে। আর সরু চাল (নাজিরশাইল ও মিনিকেট) বিক্রি হয়েছে ৬৫ টাকা কেজি দরে।
করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে চালের দাম কমাতে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও কার্যত সুফল মেলেনি। শেষ চেষ্টা হিসেবে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তারই ধারাবাহিকতায় আগস্টে ৪১৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ১৬ লাখ ৯৩ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার।
আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। সেই সঙ্গে চলতে থাকে সরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি। এরপরও দাম কমার কোনো বালাই নেই; উল্টো সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে এক-দেড় টাকা করে বেড়ে চলেছে চালের দাম।
আগামীতে চালের দাম কমার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না চাল ব্যবসায়ী, মিল মালিকরাও। তারা আশ্বস্ত করেছেন, যাদের চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে, তারা যদি ঠিকঠাকমতো আমদানি করে, তাহলে দাম আর খুব একটা বাড়বে না।
খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, ‘আমরা আশাবাদী যে চালের দাম কমে আসবে। আমন মৌসুমে ধান কাটার আগেই আমদানি প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়া হবে, যাতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।’
মজুত পরিস্থিতি
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারের গুদামগুলোতে খাদ্যশস্যের মজুত ছিল ১৮ লাখ ২১ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ১৬ লাখ টন ও গম ১ লাখ ৬৪ হাজার টন। আর ধান ৮৮ লাখ টন।
চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে গত ১২ আগস্ট পণ্যটির আমদানির শুল্ক কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চালের আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়।
এরপর প্রথম দফায় গত ১৭ আগস্ট ৪১ প্রতিষ্ঠানকে ৪ লাখ ১০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। এরপর ১৮ আগস্ট ৬৯ প্রতিষ্ঠানকে ৪ লাখ ১৮ হাজার টন, ২১ আগস্ট ৯১ প্রতিষ্ঠানকে ৩ লাখ ৯১ হাজার টন, ২২ আগস্ট ৭৩ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে ২ লাখ ২২ হাজার টন, ২৩ আগস্ট ৯৪ হাজার টনের জন্য ৪১ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে, ২৪ আগস্ট ৫৭ হাজার টনের জন্য ৩৪ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে এবং সর্বশেষ ৩১ আগস্ট ৭৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ১ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়।
সব মিলিয়ে এ দফায় ৪১৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ১৬ লাখ ৯৩ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে নন-বাসমতি সিদ্ধ চাল রয়েছে ১৪ লাখ ৮৩ হাজার টন। বাকি ২ লাখ ১০ হাজার টন আতপ চাল।
এ চাল আমদানি করে তা আগামী ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাজারে বিক্রি করার শর্ত দেয়া হয়েছে আমদানিকারকদের।
৭ দিনে বেসরকারি পর্যায়ে ১৬ হাজার টন আমদানি
অনুমতির পর বেসরকারি উদ্যোগে শুরু হয় চাল আমদানি। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) বেসরকারি পর্যায়ে কোনো চাল আমদানি হয়নি। চলতি মাসের ৭ দিনে (১ থেকে ৭ সেপ্টেম্বর) ১৬ হাজার ২৪০ টন চাল আমদানি করা হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৩ লাখ ১৮ হাজার ৩০ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৬৪০ টন সরকার সরাসরি আমদানি করে গুদামগুলোতে মজুত করেছে। বাকি ১৬ হাজার ২৪০ টন বেসরকারি উদ্যোগে আমদানি করা হয়েছে।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে (১ জুলাই থেকে ৭ সেপ্টেম্বর) মোট ৭ লাখ ৮৬ হাজার ২৮০ টন চাল আমদানি হয়েছিল, যার পুরোটাই সরকারি পর্যায়ে। ওই সময়ে বেসরকারি উদ্যোগে কোনো চাল আমদানি হয়নি।
আন্তর্জাতিক বাজারে এখন প্রতি টন সিদ্ধ চাল ৩৫৫ থেকে ৩৮৫ ডলারে এবং আতপ চাল ৩৬১ থেকে ৩৯৫ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। গত এক বছর ধরেই এ দাম। ভারত, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে চাল আমদানি করে বাংলাদেশ। বেশির ভাগই আসে ভারত থেকে।
এবার বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। আনুমানিক প্রায় ২ কোটি টনেরও বেশি ধান কাটা হয়েছে। তবুও চালের দাম কমেনি।
বোরো মৌসুমের আগে ২০২১ সালের শুরু থেকেই চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারি গুদামে মজুত এবং বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকারি গুদামে চালের মজুত ছিল মাত্র ৫ লাখ ২৫ হাজার টন, যা ছিল অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে কম।
দেশে সরকারি চালের গুদামগুলোতে মজুতের ক্ষমতা প্রায় ২৫ লাখ টন। এসব গুদামে ন্যূনতম ১২ থেকে ১৫ লাখ টনের মজুত রাখার নিয়ম রয়েছে। গত বছরও একই সময়ে ১৩ লাখ টনের বেশি চাল মজুত ছিল।
সরকারের মজুত সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসায় গত ফেব্রুয়ারিতে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম বেড়ে ৫০ টাকায় ওঠে। সরকার স্থানীয় বাজার থেকে ৯ লাখ ৩২ হাজার টন বোরো ও ৩ লাখ ৫০ হাজার টন অন্য জাতের চাল সংগ্রহ করে মজুত বাড়ালেও বাজারে দাম আর কমেনি।
সেসময় বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হলেও শুল্ক বেশি হওয়ায় খুব বেশি চাল আমদানি করেননি ব্যবসায়ীরা।
গত ২৪ আগস্ট পর্যন্ত সরকারের গুদামগুলোতে মোট ১৭ লাখ ২৫ হাজার টন খাদ্য মজুত ছিল। এর মধ্যে ১৪ লাখ ৯ হাজার টন চাল এবং বাকিটা ধান, গম ও আটা।
গত বছরের আগস্ট শেষে এই মজুতের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ১৪ হাজার টন। এর মধ্যে ৯ লাখ ৮৫ হাজার টন চাল ছিল।
দাম কমার সম্ভাবনা নেই
সরকারের গুদামগুলোতে প্রচুর চাল মজুত থাকার পরও দাম কেন কমছে না, এমন প্রশ্ন করা হয় বাংলাদেশ চাল ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি জাকির হোসেন রনির কাছে।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কী বেসরকারি পর্যায়ে আসলে খুব একটা চাল আমদানি হচ্ছে না। আগেরবার যখন ব্যবসায়ীদের কোটা নির্ধারণ করে দিয়ে আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছিল, সেই কোটা কিন্তু ব্যবসায়ীরা পূরণ করেনি। এবার কী হবে, জানি না।’
জাকির হোসেন বলেন, ‘আসলে ব্যবসায়ীরা চাল আমদানি করবেন কি না, তা নিয়ে দ্বিধায় আছেন। অক্টোবরের শেষের দিকে আমন ধান উঠবে তখন যদি দাম কমে যায়, তাহলে তাদের লোকসান হবে। সে ভয়ে তারা আমদানি করতে সাহস পাচ্ছেন না।
‘তবে যেহেতু সরকারের কাছে প্রচুর চাল মজুত আছে, সে কারণে চালের দাম আর বাড়ার কোনো আশঙ্কা নেই। বর্তমানে যে দাম আছে, আগামী কয়েক মাস সে দামই থাকবে বলে আমার মনে হয়।’
একই প্রশ্নে বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম খোরশেদ আলম খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শুল্ক কমানোর পর এখনও চাল আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক লাগে। এত বেশি শুল্ক দিয়ে চাল আমদানি করলে ব্যবসায়ীরা লাভের মুখ দেখতে পারবেন না; লোকসান দিতে হবে। সে কারণেই বেসরকারি উদ্যোগে চাল আমদানি করতে আগ্রহ দেখান না ব্যবসায়ীরা।’
চাল আমদানিতে শুল্ক আরও কমানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারের কাছে আমার পরামর্শ হচ্ছে, চালের আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনুন। তাহলে দেখবেন প্রচুর চাল আমদানি হবে। চালকল মালিকরাও তাদের মজুত করা চাল বাজারে ছেড়ে দেবেন। তখন চালের দাম এমনিতেই কমে আসবে।
‘এভাবে ২৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে চাল আমদানির অনুমতি দিয়ে উল্টো চালকল মালিকদেরই লাভের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে বলে আমি মনে করি। কেননা সরকারিভাবে যে চাল আমদানি করা হচ্ছে, তা সরকারের গুদামে চলে যাচ্ছে, বাজারে আসছে না। দামে প্রভাব পড়ছে না। সে সুযোগে মিলমালিকরা তাদের কাছে থাকা চাল বাজারে না বিক্রি করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে আরও দাম বাড়িয়ে দিয়ে তারপর বিক্রি করছে।’
খোরশেদ আলম জানান, মিলমালিকরা আগেই ধান কিনে মজুত করে রাখেন। এ কারণে চালের দাম বাড়লেও কৃষক তার মূল্য পান না। ধান চাষে খরচের তুলনায় কম দামে বিক্রি করতে হয়। তাই কৃষক ধান চাষ থেকে সরে আসছেন। সরকার যে ধান সংগ্রহ করে সেখানে সবাই অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। তাই কম দামে মিল মালিকদের কাছে বিক্রি করতে হয়।
মানুষকে আর কত দুর্ভোগ পোহাতে হবে?
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক কৃষি অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামানের মতে, চালের দাম না কমায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন চাল ব্যবসায়ী এবং চালকল মালিকরা। আবার তাদেরই চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়। তারা দ্রুত চাল আমদানি করলে দাম কমে যেতে পারে। সে কারণেই তারা আমদানিতে গড়িমসি করেন।
তিনি বলেন, ‘এরা সবাই মিলে একটা বড় সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। দীর্ঘদিন ধরে চলছে এই সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি সরকার, দেশের মানুষ। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া ছাড়া কোনোভাবেই চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামনো যাবে না।’
আক্ষেপ করে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমার খুবই অবাক লাগে, মহামারির এই সংকটকালেও চালের দাম এক পয়সা কমল না। অথচ ধান উৎপাদন হয়েছে পর্যাপ্ত; মজুত আছে প্রচুর। মানুষকে আর কত দুর্ভোগ পোহাতে হবে?’