রাজধানীর মালিবাগের ঢাকা ক্যাডেট স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী মালিহা। এই স্কুলে আর যাওয়া হবে না তার। কারণ, স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেছে করোনার কারণে।
১৭ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সময় মালিহা অনলাইনেও ক্লাস করেনি। পড়াশোনা করেছে বাসাতেই। এবার তাকে নতুন স্কুলে ভর্তি হতে হবে।
এখানেই জটিলতা। ঢাকা ক্যাডেট যেখানে ছিল, তার এক থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে আরও তিনটি স্কুল ছিল, যার প্রতিটিই বন্ধ হয়ে গেছে।
তাহলে মেয়ের পড়াশোনার কী হবে?
মা আফরোজা বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাধ্য হয়েছি মেনে নিতে। কী করব বলেন। বছরের বাকি তিনমাস আর ওকে কোনো স্কুলে দিব না। নতুন বছরে অন্য কোথাও ভর্তি করব।’
তবে এই অন্য কোথাও ভর্তি করাটা যে সহজ হবে না, সেই বিষয়টি আফরোজা জানেন না। তার এলাকার চারটি স্কুলই বন্ধ। রাজধানীতে শিশুদেরকে দূরের স্কুলে যাওয়া-আসা করা বেশ কষ্টকর বলে বাসার পাশের স্কুলেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন অভিভাবকরা। তাই স্কুলের পাশেই সাধারণত বাসা নিয়ে থাকেন। ফলে মালিহার পরিবারকেও এমনটি করতে হতে পারে যদি না এই চার স্কুলের একটি চালু না হয়।
মালিবাগের এই চারটি স্কুলের মতো সারাদেশে প্রায় ১৫ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা জানাচ্ছে এই স্কুলগুলোর সমিতি বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। তাদের হিসেবে প্রতি চারটি স্কুলের একটির আর কোনো অস্তিত্ব নেই।
করোনার কারণে রাজধানীর মালিবাগের এই কিন্ডারগার্টেন স্কুলটির (ঢাকা ক্যাডেট স্কুল) আশপাশের দেড় কিলোমিটারে মধ্যে আরও তিনটি স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে এ এলাকার মতো শহর অঞ্চলের হাজারো শিশুদের স্কুলে যাওয়া অনিশ্চতায় পড়তে পারে। ছবি: নিউজবাংলা
যখন স্কুল বন্ধ হয়, মাসের পর মাস খরচ মিটিয়ে সঞ্চয় বা জমিজমা বিক্রি করেও পাওনা পরিশোধ করেছেন মালিকরা। নতুন করে স্কুল চালুর সঙ্গতি নেই বহুজনের।
কিন্ডারগার্টেন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন তথ্য বলছে, সারাদেশে ৬০ হাজারের বেশি স্কুল ছিল করোনার আগে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী ছিলেন ১২ লাখ। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০ লাখ।
সারাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা পৌনে তিন কোটির কিছু বেশি। এদের মধ্যে সরকারি স্কুলে পড়ে দুই কোটির কাছাকাছি। এদের সিংহভাগই মফস্বল ও গ্রাম এলাকার। আর বড় শহরের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই এখন কিন্ডারগার্টেনে পড়ে। আর এরাই এখন স্কুলে ভর্তি হওয়ার সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে।
রাজধানীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে হাতে গোণা কয়েকটি। আর তাতে নিম্ন আয়ের মানুষদের সন্তানরাই মূলত ভর্তি হয়। সেখানে পরিবেশ, অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে মধ্যবিত্তরা তাদের সন্তানদেরকে পাঠাতে আগ্রহী হন না।
ফলে সারা দেশে প্রাথমিকে ভর্তির আসন হিসেব করলেই শিশুদের পড়াশোনার সংকট বোঝা যাবে না। শহর এলাকায় হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে লাখ লাখ শিশুর ভর্তিই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক এই বিষয়ে কথাই বলতে চান না। এর কারণ হিসেবে তিনি কিন্ডারগার্টেনের সরকারি নথিভুক্ত না থাকার কথা জানান।
তাহলে লাখ লাখ শিশুর ভর্তির সংকটকে আপনারা কি গুরুত্ব দিচ্ছেন না? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কিন্ডারগার্টেনগুলোর কোনো সরকারি অনুমোদন নেই। তারপরও নতুন শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীদের বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় থাকবে।’
আবার শিক্ষার্থীরা খুব একটা স্কুলে আসবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশন এর মহাসচিব জি এম জাহাঙ্গীর কবির রানা।
তিনি বলেন, ‘স্কুল-কলেজ খোলার ঘোষণার পর আমরা অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। কিন্তু তেমন আশানুরূপ ফল পাচ্ছি না। কেউ বলছে ছেলেকে মাদ্রাসায় ভর্তি করেছেন, কেউবা সপরিবারে গ্রামে চলে গেছেন। আর আমাদের অনেক শিক্ষকও পেশা বদল করেছে।’
তিনি বলেন, ‘যেসব কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে সেসব স্কুলের শিক্ষার্থীরা চাইলে পাশের স্কুলে মাইগ্রেশন করতে পারে। তবে আমার মনে হয় না খুব বেশি শিক্ষার্থী মাইগ্রেশন করবে। কেননা তাহলে নতুন স্কুলে পুরো বছরের বেতন দিতে হবে।’
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম ভুইয়া বলেন, ‘এ বছরের বাকি কয়েকমাাসের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলায় এখন আমরা আরও বিপদে পড়েছি। কেননা অধিকাংশ অভিভাবকই বাকি কয়েক মাসের জন্য শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠাবে না। আর যেসব কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে তাদের শিক্ষার্থীরা যাতে যদি অন্য কিন্ডারগার্টেন এ ভর্তি হতে পারে সে বিষয়ে সভা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আমরা নতুন বছরকে মাথায় রেখেই আবার শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সংগ্রহে কাজ করছি।’
কিন্ডারগার্টেন ও সমমান স্কুল রক্ষা জাতীয় কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী মোহাম্মদ আবদুল অদুদ বলেন, ‘করোনার কারণে ১৭ মাস বন্ধ শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আমরা কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়গুলোর দৈন্যতা নিরসনে সরকারের কাছে ১০ হাজার কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা চেয়েছি। মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে আমাদের প্রস্তাব তোলা হয়েছে ও বিশেষজ্ঞ কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তবে আমারা এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি আশ্বাস পাইনি।’
২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে করোনা সংক্রমণের প্রমাণ পাওয়ার পর ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এরপর দফায় দফায় বাড়ানো হয় ছুটির মেয়াদ। সর্বশেষ ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়। এই ছুটি শেষে ১২ সেপ্টেম্বর থেকে খুলবে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।