গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে রংপুর চিনিকলের জমি থেকে উচ্ছেদ ও আখ কাটাকে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর স্থানীয় সাঁওতাল-পল্লিতে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও তিন সাঁওতালকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় তীব্র সমালোচনা হয়েছিল দেশজুড়ে। সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন দেয়ার ভিডিও হয়েছিল ভাইরাল। এসেছিল বিশ্ব মিডিয়ায়ও।
এরপর দীর্ঘদিন এ নিয়ে আলোচনা ছিল না। ২০১৬ সালের সেই ঘটনার পর চিনিকলের ১ হাজার ৮৪২ একর জমি পুরোটাই প্রায় দখলে নেয় সাঁওতাল জনগোষ্ঠী।
পরবর্তী সময়ে কিছু জমিতে অবশ্য কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে এই জনগোষ্ঠীর যাতায়াত বন্ধ করে দেয় মিল কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে গত বছর সরকারের সিদ্ধান্তে বন্ধ হয়ে যায় রংপুর চিনিকলসহ দেশের বেশ কয়েকটি চিনিকল। এরপর থেকে পুরো সম্পত্তিই দখলে নিয়েছে সাঁওতালরা।
সম্প্রতি এই এলাকা নিয়ে ফের উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় দুই হাজার একরের এই জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল ইপিজেড (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর জমি পরিদর্শনসহ পরবর্তী কাজও শুরু করেছে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা)।
এর পরই এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন সাঁওতালরা। এ জমি নিজেদের দাবি করে ফের আন্দোলনে নেমে সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন তারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাসিন্দারা।
জনগোষ্ঠীটির দাবি, ইপিজেড স্থাপন সাঁওতালদের নিঃস্ব করার পরিকল্পনা। ৬ নভেম্বরে মানুষ হত্যা করেও উচ্ছেদে ব্যর্থ হয়ে সরকার নতুন করে ইপিজেড স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে তারা এ সিদ্ধান্ত মানবেন না। তিন ফসলি এই জমিতে কৃষি আবাদই হবে; ইপিজেড নয়। জীবন দিয়ে হলেও তারা বাপ-দাদার জমি রক্ষার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন।
স্থানীয় একটি পক্ষ অবশ্য বলছে অন্য কথা। তাদের দাবি, চিনিকলের জমিতে ইপিজেড হলে অসংখ্য শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে গাইবান্ধাসহ উত্তরাঞ্চলের ২ লাখ মানুষের।
প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে এ অঞ্চলের মানুষদের মিষ্টি বিতরণ ও আনন্দ মিছিল করতেও দেখা গেছে।
প্রশাসন বলছে, চিনিকলের জমিতে ইপিজেড হলে এ অঞ্চলের শিক্ষিত ও বেকার যুবকরা চাকরির সুযোগ পাবেন। গাইবান্ধাসহ পুরো রংপুর বিভাগের জীবনমানে পরিবর্তন আসবে। সেখানে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীই বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। উত্তরাঞ্চল হবে অর্থনৈতিক এলাকা; যা জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
তবে সরকারের বৃহত্তর এই পরিকল্পনা মানতে রাজি নয় সাঁওতালরা। গত শনিবার ইপিজেড স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে ভূমি পুনরুদ্ধার কমিটির ব্যানারে গোবিন্দগঞ্জের মাদারগঞ্জ এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছেন তারা।
একই ধরনের কর্মসূচি ছাড়াও বেশ কিছু দিন ধরে ঘোড়াঘাট-দিনাজপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক অবরোধ, মানববন্ধন ও প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন-স্মারকলিপির মাধ্যমেও এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে জনগোষ্ঠীটি।
এসব কর্মসূচিতে সাঁওতাল নেতারা জানান, ফসলি জমি নষ্ট করে শিল্পকারখানা স্থাপনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিষেধ রয়েছে। তারপরও একটি মহল বেপজা কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করে সাঁওতাল-পল্লির তিন ফসলি জমিতে শিল্পকারখানা স্থাপনের পাঁয়তারা করছে; যা কোনোভাবেই মানবেন না তারা।
তারা আরও জানান, ১৯৫৩-৫৪ সালে বাঙালি ও সাঁওতালদের কাছ থেকে এসব জমি অধিগ্রহণ করে রংপুর চিনিকল। শর্ত অনুযায়ী, কখনও মিল বন্ধ হয়ে গেলে বা জমিতে আখ চাষ না হলে জমি প্রকৃত মালিকরা ফেরত পাবেন। বর্তমানে মিল বন্ধসহ আখ চাষ বন্ধ হওয়ায় সেই শর্ত শেষ হয়েছে। তাই এই জমির পৈতৃক সূত্রে মালিক সাঁওতাল ও বাঙালিরা।
সাঁওতাল-পল্লি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ইপিজেড স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের খবরে পতিত জমিগুলোতেও ছোট ছোট নতুন ছাপরা ঘর নির্মাণ করে দখলে নিয়েছেন সাঁওতালরা, যা সেই ৬ নভেম্বরের ঘটনার সঙ্গে মিলে যায়। এ ছাড়া তারা দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে বসবাস করে এলেও এখন জমি হাতছাড়া না করতে ভিন্ন ভিন্ন জমিতে ছাপরায় বসবাস শুরু করেছেন।
ইপিজেড স্থাপনের বিরোধিতা করে সাঁওতাল-পল্লির চামগড়া এলাকার টাটু টুডু বলেন, ‘আমি চাই আমার বাপ-দাদার পৈতৃক জমি সরকার ফিরত দেক। আমাদের সরিয়ে দিয়ে সরকার ইপিজেড করতি পারে না। এটা হতে দিব না। জীবন দিব, কিন্তু জমি দেব না।’
৬ নভেম্বরে ঘটনায় পুলিশের গুলিতে পা হারানো পল্লীর বিমল কিসকু বলেন, ‘আমরা বাপ-দাদার ভিটেতে চাষাবাদ করে থাকতে চাই। খাইতে চাই। আমরা কৃষি লোক, চাষবাদ করব; বাপ-দাদার জমিতে থাকব। ইপিজেড আমরা আশ্রয়ও দিব না। জমিতে কিছু তুলতিই দিব না।’
সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি বার্নাবাস টুডু বলেন, ‘২০১৬ সালে অনেকভাবে আমাদের নির্যাতন করা হইছে। পুলিশসহকারে এলাকার যারা প্রভাবশালী তারা আমাদের নির্যাতন করেছে। গুলি করে আমাদের তিনজন ভাইকে মেরে ফেলছে। আমাদের ঘরে আগুন লাগে দিছে। লুটপাট করছে। বাপ-দাদার এই পৈতৃক ভিটে আমরা মরলেও ছাড়ব না। ইপিজেড হতে দিব না।’
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জাফরুল ইসলাম প্রধান বলেন, ‘এই সম্পত্তি আমাদের মা। এই সম্পত্তি আমাদের জীবন। এটাই আমাদের অস্তিত্ব। এখানে আমরা জীবন দিয়ে হলেও জমি রক্ষা করব।’
স্বাধীনতাযুদ্ধে সাঁওতালদের বিভিন্ন অবদানের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরাও দেশের উন্নয়ন চাই। তবে নৃগোষ্ঠী সাঁওতাল সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ, নিঃস্ব করে সেই উন্নয়ন করাটা কতটুকু যৌক্তিক?’
সরকার দ্রুত ইপিজেড স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিল না করলে বৃহত্তর আন্দোলনের ঘোষণাও দেন তিনি।
৬ নভেম্বর সাঁওতাল-পল্লিতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনার মামলার বাদী থমাস হেমব্রম বলেন, ‘সরকারের যে কর্তৃপক্ষ আমাদের বাপ-দাদার জমিতে ইপিজেড করতে চাচ্ছে; তা আমরা দেব না। আমরা তিন-তিনটে ভাই হারাছি, দরকার হলে আমরাও জীবন দিব, তবুও জমিতে একটা ইট পুঁততে দেব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘৬ নভেম্বর গুলি করে হত্যা, হামলা, লুটপাটের মামলার বাদী হয়েও হয়তো এর বিচার দেখে যেতে পারব না। কারণ বারবার ভুল ও ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ছাড়া মামলার মূল আসামিদের বারবার চার্জশিট থেকে নাম বাদ দেয়া হচ্ছে।’
সাঁওতালরা বিরোধিতা করলেও স্থানীয়দের একটি অংশ আবার ইপিজেড করার পক্ষে।
স্থানীয় পাড়া কচুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এ এফ এম শরিফুজ্জামান শরীফ বলেন, ‘ইপিজেড হলে এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়ন হবে। এখানে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। গোবিন্দগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলে উন্নয়ন হবে।’
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শেমলেন্দু মোহন রায় জিবু বাবু বলেন, ‘সাঁওতালদের আমরা কখনোই আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবি না। তারা তো শুধু ১২ শতাংশ। আর আমরা হিন্দু-মুসলিম ৮৮ শতাংশ। তাহলে এই সম্পত্তি তারা তাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি বলে চালিয়ে দিলে তো হবে না। যত দ্রুত সম্ভব এই ইপিজেড বাস্তবায়ন হোক, এটাই আমি চাই।’
এমন অবস্থায় গত ২৪ আগস্ট ইপিজেড বাস্তবায়নে রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল নজরুল ইসলাম। এর আগে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে এক মতবিনিময় সভায় অংশ নেন তিনি।
ওই সময় তিনি বলেন, ‘গোবিন্দগঞ্জে ইপিজেড স্থাপনের মাধ্যমে এমন একটা কর্মপরিবেশ তৈরি করা হবে, যা হবে আন্তর্জাতিক মানের। সরকার কখনও সাধারণ মানুষের অমঙ্গল কামনা করে না। বৃহত্তর রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের মাঝামাঝি এই গোবিন্দগঞ্জে ইপিজেড এই বৃহৎ অঞ্চলের আমূল পরিবর্তন ঘটাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই ইপিজেড দুই লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। ইপিজেড এখানে দেবে মিনি ক্যান্টনমেন্ট। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে। তা ছাড়া এখানে আন্তর্জাতিক মানের কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা হবে।’
এ ছাড়া এখানকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানসহ তাদের পুনর্বাসনের আশ্বাসও দেন তিনি।
সাঁওতালরা আন্দোলন শুরু করলেও এবার স্থানীয় প্রশাসন বেশ সতর্ক। সাঁওতালদের সঙ্গে কোনো সংঘাত নয় বরং শান্তিপূর্ণ আলোচনার কথা জানিয়েছে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন।
ইউএনও আবু সাঈদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ইপিজেড স্থাপন সরকারি সিদ্ধান্ত। এর বিরোধিতা করে কেউ অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটাতে পারে, সে জন্য সজাগ রয়েছে উপজেলা প্রশাসন।’
৬ নভেম্বরের ঘটনা যেভাবে
১৯৫৩-৫৪ সালে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জে রংপুর চিনিকলের আখ চাষের জন্য উপজেলার সাপমারা ও কাটাবাড়ী ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের ১ হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে সরকার। এ জমির মধ্যে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ছিল ২৭ শতাংশ এবং স্থানীয় মুসলমানদের ৭৩ শতাংশ। জমি অধিগ্রহণের পর এর নামকরণ করা হয় সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম।
২০১৬ সালের জুলাইয়ে সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের প্রায় ১০০ একর জমিতে ছোট ছোট ছাপরা ও ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস শুরু করেন সাঁওতাল-বাঙালিরা। ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর সকালে আখ কাটা নিয়ে পুলিশসহ চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ বাধে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিন সাঁওতাল নিহত হন। আহত হন উভয় পক্ষের কমপক্ষে ৩০ জন।
ওই দিন সন্ধ্যার দিকে সাঁওতালদের ঘরে আগুন দিয়ে উচ্ছেদের চেষ্টা চালায় পুলিশ ও প্রশাসন। এ ঘটনায় দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। পরে ধীরে ধীরে ওই এলাকা সাঁওতালদের দখলে চলে যায়।