যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, তাদের শাস্তি চেয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। তবে অনিচ্ছাকৃত খেলাপিদের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন।
ব্যাংক এমডিদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৃহস্পতিবার সকালে শুরু হওয়া মতবিনিময় সভায় এমন দাবি তুলে ধরা হয়।
এফবিসিসিআই বলছে, বেসরকারি খাতে ঋণ কেন বাড়ছে না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। এ সময় শিল্পঋণের ডাউন্ট পেমেন্টের হার ২ শতাংশ রাখার দাবি জানানো হয়।
রাজধানীর বনানীতে একটি হোটেলে মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির চেয়ারম্যান ও ইস্টার্ন ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার। এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবুসহ অনেকেই বক্তব্য দেন। সরকারি-বেসরকারি ৩২টি ব্যাংকের এমডি এতে উপস্থিত ছিলেন।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে এসএমই খাতকে এগিয়ে নিতে হবে। কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে এই খাতের বিকল্প নেই। এ জন্য প্রণোদনার ঋণ ঠিকমতো বিতরণের পাশাপাশি সহজ শর্তে জামানতবিহীন ঋণও দরকার।
তিনি বলেন, এসএমই খাতে ৫ থেকে ৭ বছর মেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। শিল্পঋণ পুনঃতফসিলে ডাউন পেমেন্টের হার সর্বোচ্চ ১ থেকে ২ শতাংশ নির্ধারণ করলে দেশের শিল্পায়ন সহজ হবে।
সভা থেকে ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আয়করের হার সাড়ে ৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করার দাবি জানান তিনি।
ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে প্রয়োজনে এফবিসিসিআইয়ের উদ্যোগে ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করার আহ্বান জানান আলী রেজা ইফতেখার। তিনি বলেন, ঋণ সবার জন্য ক্ষতির কারণ।
এফবিসিসিআইয়ের দাবি
সভায় মেয়াদি ঋণের সময়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দীন বলেন, ‘এসএমইদের চলতি মূলধনের চাহিদা পূরণে চলমান ঋণ দেয়া অব্যাহত রাখার এবং ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে মেয়াদি ঋণের সময়সীমা ১ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ বছর পর্যন্ত রাখার বিধান রয়েছে।
‘তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়াদি ঋণের সময়সীমা এক বছর হয়ে থাকে, যার ফলে ঋণ পরিশোধে সমস্যা দেখা দেয়। এসএমই খাতের টার্ম লোনের (মেয়াদি ঋণ) মেয়াদ দীর্ঘমেয়াদি (৭-১০ বছর) করার পাশাপাশি গ্রেস পিরিয়ড দুই বছর করা জরুরি।
‘ঋণ দীর্ঘমেয়াদি করা হলে কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলোর ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আরও বাড়বে। পাশাপাশি নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।’
এফবিসিসিআই সভাপতি আরও বলেন, ‘শিল্পকারখানার জন্য ১৫ বছর মেয়াদি ঋণ দরকার। কিন্তু তা ব্যাংক থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন করে ৩০ থেকে ৩৫টি সুতার মিল হচ্ছে। এসব ঋণের মেয়াদ দীর্ঘমেয়াদি না হলে সব খেলাপি হয়ে পড়বে।’
এক্সপোর্ট বিল অনেক ক্ষেত্রে সময়মতো পরিশোধ করা হয় না অভিযোগ করে ব্যবসায়ীদের এ শীর্ষ নেতা দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষায় প্রয়োজনে ফোর্স লোন করে যথাসময়ে এক্সপোর্ট বিল পরিশোধের প্রস্তাব দেন।
জসিম উদ্দীন জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ সালে ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট দেয়ার বিশেষ সার্কুলার জারি করলেও ২ শতাংশ টাকা জমা দেয়ার পরও ব্যাংকের সিদ্ধান্তহীনতায় অনেক গ্রাহকই এ সুবিধা নিতে পারেননি। এতে শিল্পায়নে সহায়তার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকারের লক্ষ্য বিঘ্নিত হচ্ছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও রুগন্ শিল্পগুলোকে এ সুবিধা দিতে ব্যাংকের অনীহার কারণে সেগুলো এক্সিট নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমছে না।
এফবিসিসিআই সভাপতির অভিযোগ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সার্কুলার থাকার পরও অধিকাংশ ব্যাংক নন-টেক্সটাইল খাতের রুগন্ শিল্পের দায়-দেনা নিষ্পত্তিতে অনাগ্রহী হওয়ায় বিষয়টি অনিষ্পন্ন অবস্থায় আছে। এতে ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ অনাদায়ী অর্থ আদায়ে দেরি হচ্ছে। যেসব শিল্পের ঋণ হিসাব রাইট অফ করা আছে সেগুলো এমনিতেই মৃত। সেগুলোকে সহজ-শর্তে এক্সিট দেয়ার সুযোগ দিলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অনেকাংশে কমে যাবে।
ব্যাংকের সার্ভিস চার্জের বিষয়েও কথা বলেন এফবিসিসিআই সভাপতি। বলেন, ‘প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজার পরিস্থিতিতে সরকার কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস কমানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যবসার খরচ কমানোর জন্য সব ব্যাংকের সার্ভিস চার্জের হার একই হওয়া প্রয়োজন।’
এসব বিষয়ে এবিবির চেয়ারম্যান আলী রেজা ইফতেখার বলেন, ‘খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের কাছাকাছি। এটা আমাদের ধ্বংস করে দিচ্ছে।
‘ব্যবসা চালু রাখার জন্য ব্যাংকাররা সব উদ্যোগ নেবে। তবে যেসব ইচ্ছাকৃত খেলাপি রয়েছে তাদের ঋণ আদায়ে এফবিসিসিআই যেন সহযোগিতা করে।’
সার্ভিস চার্জ বিষয়ে তিনি বলেন, যেকোনো দেশের তুলনায় আমাদের ব্যাংকগুলোতে সার্ভিস চার্জ অনেক কম। সব ব্যাংকের চার্জ সমান হবে না। আমরা সেবা দেব, বিনিময়ে কিছু তো আপনাদের দিতে হবে।’
এবিবির সেক্রেটারি মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘যে দেশে সব ঋণের সুদহার এক, সেখানে ঋণের প্রবৃদ্ধি কম হওয়ার এটাও একটি কারণ। ঋণের খরচের ওপর নির্ভর করে সুদ ঠিক করা প্রয়োজন। এখন যেভাবে বিভিন্ন সেবা মাশুল নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে, তাতে ব্যাংক খাতের আয় ১২ থেকে ১৩ শতাংশ কমে আসবে।’
প্রণোদনা অনুদান নয়, ঋণ
মতবিনিময় সভায় জানানো হয়, এসএমই খাতে প্রণোদনার ৭৭ শতাংশ ঋণ বাস্তবায়িত হয়েছে।
এ বিষয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘এসএমই খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে সহজ শর্তে বেশি প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক এ খাতের জন্য ব্যাংকগুলোতে ডেডিকেটেড ডেস্ক চালু, এসএমই সার্ভিস সেন্টার, নতুন ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রবর্তনসহ বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে।
‘তবে বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো কোনো ব্যাংকে এসব ইতিবাচক উদ্যোগ বাস্তবায়নে অনীহা দেখা গেছে। আমরা আহ্বান করছি, যাতে সব ব্যাংকের শাখাগুলোতে এসএমইদের সহায়তায় হেল্প ডেস্ক কার্যকরভাবে নিশ্চিত করা হয়।’
এবিবির চেয়ারম্যান আলী রেজা ইফতেখার এ বিষয়ে বলেন, ‘প্রণোদনা কোনো অনুদান না; এটা ঋণ। ব্যাংকগুলোকেই এই টাকা ফেরত আনতে হবে। ফলে ব্যাংকগুলো দেখেশুনে ঋণ দেবে এটাই স্বাভাবিক। আর বড় ঋণ যত সহজে দেয়া যায়, এসএমই ঋণ তত সহজে দেয়া যায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এসএমইসহ সব ঋণে ৯ শতাংশ সুদ নির্ধারণের পর খরচ বিবেচনায় অনেকে এ খাতে ঋণ দিতে হয়তো অনীহা দেখাচ্ছে। কটেজ, এসএমই ও রিটেইল ঋণে ৯ শতাংশ সুদ খুব চ্যালেঞ্জিং। বড় ও ছোট ঋণের সুদ সমান হয় না। এ জন্য সুদহার নির্ধারণ ঠিক না। এরপরও প্রণোদনার আওতায় প্রায় ৮০ শতাংশ ঋণ বিতরণ হয়েছে। এটা সন্তোষজনক।’
অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে করোনার মধ্যেও সব সময় ব্যাংক খোলা রেখেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘করোনায় আমাদের ১৬০ জন ব্যাংকার প্রাণ হারিয়েছেন। ৩০ হাজারের ওপরে কর্মী কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন।’
সভায় এফবিসিসিআই সভাপতি এসএমই ঋণ বিতরণের জন্য স্থানীয় চেম্বারের সহায়তায় গ্রাহক নির্বাচন করার আহ্বান জানান। ব্যাংকগুলো এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে।