করোনার ধাক্কায় দেশে বিনিয়োগের যে খরা তৈরি হয়েছিল, তা কাটতে শুরু করেছে। ব্যাংক ব্যবস্থায় ঋণের জন্য আবেদন বাড়ছে। বেড়েছে বিতরণও। ফলে ব্যাংকে যে অতিরিক্ত তারল্যের পাহাড় জমেছিল, তা ছোট হতে শুরু করেছে।
চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিক জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত যত টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, দ্বিতীয় প্রান্তিকে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ব্যাংকাররা আশা করছেন, ঋণ বিতরণ আরও বাড়বে।
গত বছরের মার্চে করোনার আঘাতের পর বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ তলানিতে নামে। অর্থনীতির ওপর আঘাত মোকাবিলায় সরকার ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে, তার বাইরে ঋণ প্রস্তাব ছিল না বললেই চলে।
এই প্রণোদনার পরও গত জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ শতাংশের মতো, অথচ লক্ষ্য ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। বিনিয়োগের এমন খরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কখনও হয়নি।
চলতি অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগের বছরের মতোই ঋণে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরেছে।
এরই মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা কাটিয়ে উদ্যোক্তারাও উৎপাদন শুরু করার এবং নতুন কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করেছেন।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রেজবিন হাফিজ। তার কারখানায় উৎপাদন হয় চামড়াজাত পণ্য। রপ্তানি বাজারে নিজস্ব স্বকীয়তায় অবস্থান তৈরি করা এ উদ্যোক্তার উদ্দেশ্য।
মাঝারি উদ্যোক্তারা তাদের কারখানা খুলেছে অনেক দিন পর, উৎপাদন বাড়ানোর আশাবাদ। ছবি: নিউজবাংলা
নানামুখী প্রচেষ্টায় বাড়ছিল পণ্যের চাহিদাও। কিন্তু করোনা মহামারিতে ভেঙে যায় হাফিজের স্বপ্ন। ঘুরে দাঁড়াতে বাধা হয়ে সামনে আসে আর্থিক সংকট। দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো ব্যাংক থেকে অর্থ সহযোগিতা পাননি তিনি। ফলে থমকে যায় সবকিছু।
তবে এখন আবার তার ঋণ প্রস্তাব গ্রহণ করেছে ব্যাংক।
পিপলস ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার গুডসের স্বত্বাধিকারী রেজবিন হাফিজ জানান, ‘করোনার শুরুতে ব্যাংকগুলো সহায়তা করেনি। ব্যাংকের কাছে আমি বিশ্বস্ত থাকলেও ওই সময়ে তাদের অনেকেই আমাকে চিনেননি। কিন্তু এখন সেই মেঘ কাটছে। ব্যাংকগুলো ঋণ আবেদন গ্রহণ করছে, ঋণ দেবার প্রক্রিয়াও সহজ করা হয়েছে। ইতিবাচক এমন অবস্থায় ব্যবসা বড় করা সম্ভব।’
এই নারী উদ্যোক্তার মতোই ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোক্তারা এখন স্বপ্ন দেখছেন। অর্থায়ন নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলো ঋণ কার্যক্রম বেগবান করেছে।
একাধিক উদ্যোক্তা জানান, ঋণ পেতে যে সমস্যা ছিল তা এখন ধীরে ধীরে কাটছে। বিশেষ করে বড় উদ্যোক্তারা এত দিন স্বল্প সুদে ঋণ পেলেও, বঞ্চিত হয়েছে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোক্তারা। সাম্প্রতিক ব্যাংক ঋণের তথ্য বলছে, পাল্টাচ্ছে ঋণ বণ্টন চিত্র।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, গত জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ, যা সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি। আগের মাস জুনে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ। তারও আগে মে মাসে তা ছিল ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
করোনার বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার পর শপিং মলগুলোতে বেড়েছে কেনাকাটার ভিড়। ছবি: নিউজবাংলা
জানতে চাইলে এবি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজিং ডিরেক্টর তারিক আফজাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। এ জন্য বেসরকারি ঋণে চাহিদা তৈরি হয়েছে। সরকারঘোষিত প্রণোদনার ঋণ ছাড়াও ব্যক্তি বিনিয়োগে খরা কাটছে। ব্যাংকগুলো এখন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নে ঋণ বিতরণে আগের থেকে বেশি মনোযোগী। সামনের দিনে ঋণে গতি ফিরবে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র শিল্পে অর্থায়নের জন্য ব্যাংকগুলোতে চাপ সৃষ্টি করছে।’
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমদানি বেড়ে যাওয়ায় ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। ঋণের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু কোভিডের তৃতীয় ঢেউ যদি দেশে আঘাত হানে তবে আগামী দিনগুলো অনিশ্চিত।’
কত টাকা ঋণ বিতরণ
চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মোট ঋণ ছিল ১২ লাখ ১৩ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে এই ঋণ ছিল ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসে বিতরণ বেড়েছে ৫৪ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা।
এই ঋণের মধ্যে বেশির ভাগই বিতরণ হয়েছে দ্বিতীয় প্রান্তিকে মার্চ থেকে জুনের মধ্যে। এই সময়ে মোট বিতরণ হয়েছে ৩৫ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা।
মার্চ শেষে ঋণ ছিল ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা, যা জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে বিতরণ হয়েছিল কেবল ১৮ হাজার টাকার কিছু বেশি। অর্থাৎ বছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিতরণ বেড়েছে দ্বিগুণ।
করোনার আঘাত হানার আগে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে ব্যাংক ব্যবস্থায় ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২৪ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে সেটা দাঁড়ায় ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা।
বিক্রি বেড়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের। ছবি: নিউজবাংলা
এই সময়ে ঋণ ১ লাখ ৩৪ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা হলেও এর মধ্যে ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো ছিল প্রকৃতপক্ষে প্রণোদনার ঋণ। এই অর্থ দেয়া হয়েছে শ্রমিকদের বেতন-ভাতাসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় নির্বাহে। বিনিয়োগের জন্য প্রণোদনা পাওয়া গেছে খুব কম।
অর্থাৎ প্রণোদনার বাইরে ঋণ বিতরণ এক বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার আশপাশে ছিল। এর চেয়ে বেশি ঋণ চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই বিতরণ করা হয়ে গেছে।
কমছে অতিরিক্ত তারল্য
বিনিয়োগে গতি ফিরতে শুরু করার পাশাপাশি জুলাই মাসে ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য কিছুটা কমেছে।
জুলাই পর্যন্ত অতিরিক্ত তারল্য দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা, যা এক মাস আগে জুনে ছিল ২ লাখ ৩১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা।
ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত টাকার জুনের এ পরিসংখ্যান ছিল সর্বকালের সর্বোচ্চ।
অথচ বাজারে অতিরিক্ত টাকা তুলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিলামপ্রক্রিয়া এখনও চলমান। ৫ সেপ্টেম্বর ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিল’ নিলামের মাধ্যমে বাজার থেকে এক দিনে রেকর্ড ৭ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা তুলেছে।
সম্প্রতি এক দিনে এত বেশি টাকা তোলার নজির নেই।
এর আগে গত আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের নিলাম ডেকে ১৯ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা তোলে।