গত এক বছরে পুঁজিবাজারে মূল্য সূচক প্রায় দ্বিগুণ হলেও সামগ্রিকভাবে বাজার অতি মূল্যায়িত হয়ে যায়নি বলে মনে করেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম।
তিনি বলেছেন, কিছু কোম্পানির শেয়ারদর মাত্রা ছাড়িয়েছে। সেগুলোর ওপর নজর রাখা হচ্ছে।
নিউজবাংলাকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে শিবলী বলেন, ‘বাজার অতি মূল্যায়িত কি না, এর কিছু পরিমাপক আছে, যার মূল হচ্ছে পিই রেশিও। পিই রেশিও বিনিয়োগ উপযোগী থাকলে পুঁজিবাজারকে অতি মূল্যায়িত বলা যায় না।
‘আমরা তো নির্দিষ্ট পোর্টফোলিওতে (বিনিয়োগকারীর বিও হিসাব) যেতে পারি না। আমরা ওভারঅল (বাজারের) পিই রেশিওর প্রতি খেয়াল রাখছি। আমরা এখনও সন্তোষজনক লেভেলে আছি। এটা অতি মূল্যায়িত মার্কেট না।’
গত বছরের মে মাসে এক সংকটময় মুহূর্তে বিএসইসির দায়িত্ব নেন শিবলী রুবাইয়াত। সে সময় করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে লেনদেন ছিল স্থগিত। সাধারণ ছুটি শেষে জুলাইয়ে লেনদেন শুরু হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় উত্থান।
২০১০ সালের মহাধসের পর ঘুমিয়ে যাওয়া পুঁজিবাজারে আবার প্রাণ ফিরেছে গত এক বছরে। শেয়ারমূল্য বাড়ায় বিনিয়োগকারীদের লোকসানি বিও হিসাবগুলো মুনাফায় চলে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজার থেকে দূরে সরে যাওয়া বিনিয়োগকারীরাও ফিরতে শুরু করেছে।
শেয়ার কেনাবেচায় যে ধুম পড়েছে, তা লেনদেনেই স্পষ্ট। চার থেকে ৫০০ কোটি টাকার ঘর থেকে লেনদেন এখন আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি হচ্ছে প্রায় নিয়মিতই।
লেনদেন বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে শেয়ারের মূল্য। আর মূল্যের প্রভাব গিয়ে পড়েছে সূচকে।
গত বছরের ২ জুলাই সূচক যেখানে ছিল ৩ হাজার ৯৮৬ পয়েন্টে, সেখান থেকে তা বেড়ে বুধবার দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ১৯৬ পয়েন্টে। এ সময়ে সূচক বেড়েছে ৩ হাজার ২১০ পয়েন্ট বা ৮০ শতাংশ।
২০১০ সালের ফেব্রুয়ারির পর সূচক কখনও এতটা উঁচুতে ওঠেনি।
এক বছরের কিছু বেশি সময়ে এ উত্থান স্বভাবতই দৃষ্টি কেড়েছে। অনেকে সাবধান করে বলছেন, পুঁজিবাজার অতি মূল্যায়িত হয়ে গেছে।
তবে পুঁজিবাজার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে বিএসইসির পক্ষ থেকে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান একাধিকবার বলেছেন, তিনি মনে করেন পুঁজিবাজার অনেক দূর যাবে।
পুঁজিবাজার অতি মূল্যায়িত কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বিএসইসি চেয়ারম্যান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাজারের পিই রেশিও যদি সন্তোষজনক লেভেলে থাকে তখন আর তাকে অতি মূল্যায়িত বলা যায় না। কেউ বললে, বুঝতে হবে এটি তিনি নিজে নিজে বলছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের পুরো মার্কেটের পিই এখনও সন্তোষজনক মাত্রায় আছে। কয়েকটি বা কিছু শেয়ারের বলা যায়, পিই রেশিও বেশি, কয়েকটির আবার কম। গড়ে গিয়ে ঠিক আছে।’
কোনো কোম্পানির শেয়ারপ্রতি যে আয়, তা দিয়ে কোম্পানির শেয়ারদরকে ভাগ করলে যে ফল আসে, তা মূল্য আয় অনুপাত বা পিই রেশিও নামে পরিচিত।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অর্ধবার্ষিক আয় ২ টাকা ২ পয়সা। এই হিসাবে আয় করে গেলে অর্থবছর শেষে আয় হবে ৪ টাকা ৪ পয়সা।
ব্যাংকটির শেয়ারদর এখন ১৬ টাকা ১০ পয়সা। কোম্পানিটির পিই রেশিও এখন ৩.৯৮। অর্থাৎ এই হারে আয় করে যেতে থাকলে শেয়ারমূল্যের সমান আয় করতে সময় লাগবে চার বছরের মতো।
পুঁজিবাজারে ২৫ পর্যন্ত পিই রেশিওকে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে ধরা হয়। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এটিই একমাত্র নির্ণায়ক নয়। সম্ভাবনাময় কোম্পানি হলে এর চেয়ে বেশি পিই রেশিওতেও বিনিয়োগ করা যায়।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে পিই রেশিও এখনও ষোলোর কিছু বেশি। প্রতিবেশী ভারতসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর পুঁজিবাজারে এ অনুপাত এর চেয়ে বেশি।
অবশ্য এটাও ঠিক যে, দুর্বল মৌলভিত্তির ও লোকসানি বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ার মূল্য অস্বাভাবিক বেশি। কোনো কোনো কোম্পানির পিই রেশিও ৫ হাজারের আশেপাশেও আছে। লোকসানি কোম্পানির পিই রেশিও হয় না। এমন কোম্পানির সংখ্যাও কম নয়।
এসব কোম্পানির শেয়ারদর কেন বাড়ছে, তা খতিয়ে দেখতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে নির্দেশ দিয়েছে বিএসইসি। স্বল্প মূলধনি কোম্পানিগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে একটি কমিটি করেছে তারা নিজেও।
বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘পিই রেশিও যেগুলোর বেশি, সেগুলোর দিকে আমরা খেয়াল রাখছি। মানুষ বেশি কেনাবেচা করে যেন কোনোভাবে ঠকে না যায়। এসব দুর্বল মৌলভিত্তির শেয়ারে যেন তাদের আকর্ষণ বেশি না থাকে, বিভিন্নভাবে নিরুৎসাহিত করছি।’
কীভাবে এটা করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বলছি। টেলিভিশনে বলছি। বিনিয়োগকারীরা যাতে ভালো মৌলভিত্তির শেয়ারে আকৃষ্ট হয়। ঝুঁকি নেয়ার ক্ষমতা না থাকলে দুর্বল মৌলভিত্তির শেয়ারে যাওয়ার কোনো দরকার নেই।’