নেটফ্লিক্সের একটি সিনেমায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক সম্পর্কে ‘অসম্মানজনক ও অবমাননাকর’ সংলাপ সরানোর বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতকে আবারও চিঠি দিয়েছে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)।
এরপরও বিতর্কিত এই সংলাপটি সরানো না হলে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে যত ধরনের ব্যবস্থা নেয়া যায়, সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।
এ ব্যাপারে বিজিএমইএ পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বুধবার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া ফরাসি সিনেমার একটি সংলাপে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য দেয়া হয়েছে। সেটি প্রত্যাহার করার জন্য আমরা ৭ থেকে ৯ আগস্ট বিজিএমইএর পক্ষ থেকে নেটফ্লিক্সের সিইও, চলচ্চিত্র পরিচালক, ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু এ বিষয়ে এখনও আশাব্যঞ্জক কোনো পদক্ষেপ দেখতে পাইনি।’
তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে আমরা আবারও ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশে ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে চিঠি দিয়েছি। আশা করছি এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে। যদি পদক্ষেপ না নেয়া হয়, তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে সে বিষয়ে আমরা চিন্তা করব।’
মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘তবে এ ধরণের অবমাননাকর সংলাপ জাতি হিসেবে আমাদের বাংলাদেশিদের অনুভূতি ও গর্বকে আহত করে। এ ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য প্রত্যাহারের জন্য আমরা সর্বোচ্চ পর্যায়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করব।’
তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমরা কোনোভাবেই ছেড়ে দেব না। বিতর্কিত সংলাপটি সরানোর আগ পর্যন্ত যত ধরনের ব্যবস্থা নেয়া যায়, সব ধরনের ব্যবস্থা নেব আমরা।’
৩০ জুলাই নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে ভ্যান ড্যাম অভিনীত সিনেমা দি লাস্ট মার্সেনারি। সিনেমাটি এখন ওই ওটিটি প্ল্যাটফর্মে জনপ্রিয়তার তালিকায় সেরা দশে রয়েছে। দর্শকপ্রিয় হওয়া সিনেমাটির একটি সংলাপে বাংলাদেশি পণ্যবিরোধী প্রচারণার অভিযোগ উঠেছে।
অনেকেই মন্তব্য করেছেন, ডেভিড শ্যারন পরিচালিত ফ্রেঞ্চ ভাষার এই সিনেমায় বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যকে নিম্নমানের বলে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
সিনেমাটির ১ ঘণ্টা ৪১ মিনিটে শুরু হওয়া দৃশ্যে দেখা যায়, একজন অভিনয়শিল্পী বলছেন, ‘হ্যাঁ, এটা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট (Ah, yes. Bulletproof tuxedo)’।
উত্তরে আরেকজন বলেন, ‘এটা মেড ইন ফ্রান্স। তবে এটি বাংলাদেশ থেকে আসলে আমি শেষ হয়ে যেতাম (Made in France. If it was from Bangladesh, I,d be gone.)।
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক সম্পর্কে ‘অসম্মানজনক ও অবমাননাকর’ এই সংলাপ সরানোর আগ পর্যন্ত দি লাস্ট মার্সেনারি সিনেমাটির সম্প্রচার বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ভিডিও স্ট্রিমিং ওয়েবসাইট নেটফ্লিক্সকে ৭ আগস্ট চিঠি দিয়েছিলেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।
একই বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ৯ আগস্ট চলচ্চিত্রটির পরিচালক, ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূতকেও চিঠি লিখেছিলেন তিনি।
কিন্তু এক মাস পার হলেও এখনও চলচ্চিত্রটি থেকে ওই সংলাপ সরানো হয়নি বা কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ কারণেই হতাশা প্রকাশ করে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বুধবার আবারও আলাদা আলাদা চিঠি লিখেছেন ফারুক হাসান। চিঠি দুটির ভাষা একই।
নতুন চিঠিতে ফারুক হাসান লিখেছেন, ‘ব্যবসা, অর্থনীতি আর সামাজিক বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যকার সম্পর্ক কয়েক দশক ধরেই বিরাজমান। আপনার এ সমর্থন দেয়ার বিষয়টিকে সামনে রেখে ২০২১ সালের ৭ আগস্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপনাকে চিঠি দিয়েছিলাম। একটি বিষয়, যা কি না বাংলাদেশিদের হৃদয়কে ‘ভেঙেচুরে’ দিয়েছে, চিঠিতে সেটি উপস্থাপন করেছিলাম।
ডেভিড শ্যারন পরিচালিত দি লাস্ট মার্সেনারি নামে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ফরাসি মুভিতে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য রয়েছে।
চিঠিতে ফারুক হাসান বলেছেন, ‘মেড ইন বাংলাদেশ শুধুমাত্র যে আমাদের জাতির জন্য গর্বের বিষয়, সেটি নয়; এর বিস্তৃতি আরও বেশি। এর মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে আমাদের গৌরবময় আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরের ধারাবাহিকতায় পোশাকশিল্প আজ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গত তিন দশক ধরে অর্থনীতির অন্যান্য খাতগুলোতেও এ শিল্পের সরব পদচারণা প্রশংসিত হয়েছে।’
চিঠিতে তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমরা আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পকে সব দিক থেকে নিরাপদ, সুরক্ষিত, সবুজ এবং টেকসই করার জন্য সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। সুরক্ষার জন্য সব নিরাপত্তা মান নিশ্চিত করেছি এবং সেরা ব্যবসায়িক অনুশীলনগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। করোনা মহামারির মধ্যে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, আন্তর্জাতিক বাজার যখন তার স্বাভাবিক গতি ফিরে পাওয়ার পথে রয়েছে, তখন আমাদের নিজস্ব ব্র্যান্ড নিয়ে এ ধরনের অযৌক্তিক ও আপত্তিকর মন্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
চিঠিতে বলা হয়, ‘এর আগে আমরা নেটফ্লিক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ওই চলচ্চিত্রের পরিচালককে আমাদের এ উদ্বেগের বিষয়টি জানিয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, তাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া পাইনি। চলচ্চিত্রটি এখনও নেটফ্লিক্সের প্লে লিস্টে রয়েছে এবং চলচ্চিত্র থেকে সেই আপত্তিকর সংলাপগুলোও সরিয়ে ফেলা হয়নি।
‘বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য আমাদের ব্যথিত করেছে। আমরা এর নিন্দা জানাই এবং আপনার বেঞ্চের মাধ্যমে ফরাসি সরকার ও চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের প্রশ্নবিদ্ধ সংলাপটি অনতিবিলম্বে অপসারণের জন্য পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।’
ফারুক হাসান বলেন, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা মানবাধিকার আইন ১৯৯৮ এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। তবে এটি অবশ্যই দায়িত্বশীলতার সঙ্গে পালন করতে হবে। এরপরও জনপ্রতিনিধিরা মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার সীমাবদ্ধ রাখার ক্ষমতা রাখেন, যদি কি না সেটি কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত খ্যাতিকে বিনষ্ট করে। এরপরও বলা যায় যে, চলচ্চিত্রে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ নিয়ে যে মন্তব্য আছে, সেটি পুরোপুরি ভুল। কারণ, বাংলাদেশ বুলেট প্রুফ জ্যাকেট তৈরি করে না। গত চার দশক ধরে আমরা যে পোশাক তৈরি করছি, সেটি বিশ্বব্যাপী ক্রেতা ও ভোক্তাদের আস্থা অর্জন করেছে তার গুণগত মান ও প্রতিযোগিতামূলক মূল্য দিয়ে।’
চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘এ কারণে বিজিএমইএ ও পোশাক শিল্প পরিবারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন এবং আপনার (রাষ্ট্রদূত) মাধ্যমে ফরাসি কর্তৃপক্ষকে চলচ্চিত্রটি থেকে প্রশ্নবিদ্ধ সংলাপটি সরিয়ে নেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।’
বিজিএমইএ পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল জানান, একই বিষয় অবহিত করে এবং সহযোগিতা চেয়ে বিজিএমইএ থেকে উল্লিখিত চলচ্চিত্রটির পরিচালক, বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব, ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে চিঠি দেয়া হয়েছে।