মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে চলে গেছে রেল ও সড়ক পথ। সেই পথে দিন দিন বাড়ছে ব্যস্ততা। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে বন্যপ্রাণীর স্বাভাবিক চলাচল।
এ অবস্থায় বনের ভেতর উল্লুকের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে দড়ি দিয়ে সেতু করে দেয়া হয়েছে। সেই সেতু কতটুকু কাজে লাগবে তা জানতে বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরাও।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইউসিএন) তালিকায় বিপন্ন প্রাণী হিসেবে লাল তালিকায় আছে উল্লুক। এর ইংরেজি নাম Western Hoolock Gibbon ও বৈজ্ঞানিক নাম Hoolock hoolock।
বিপন্ন এই প্রাণীর জন্য লাউয়াছড়ায় পাঁচটি সেতু তৈরি করে দিয়েছে বন বিভাগ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক।
এই গবেষক দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক হাবিবুন নাহারের তত্ত্বাবধানে কাজ করছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাবির বিন মোজাফফর, ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের বন্যপ্রাণী গবেষক সাবিত হাসান, গবেষক হাসান আল-রাজী, নেকমের ফিল্ড ম্যানেজার গবেষক তানভির আহমেদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাত্র সজিব বিশ্বাস ও তানিয়া আক্তার।
দলটির প্রধান হাবিবুন নাহার জানান, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-সিলেট রেললাইন এবং শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়ক। রেললাইন ও সড়ক পথে বিভক্ত হওয়া বনে ব্যাহত হচ্ছিল উল্লুকের চলাফেরা। কারণ এই প্রাণী গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে চলে। খুব বিপদে না পড়লে নিচে নামে না।
এ অবস্থায় বন অধিদপ্তরের অর্থায়নে তারা বনের ভেতরের রেললাইনের ওপর ৪টি এবং সড়ক পথে একটি সেতু তৈরি করেছেন। সেতুগুলো মূলত ১০ সেন্টিমিটার ব্যাসের দড়ি। সেগুলো উঁচু গাছে বেঁধে দেয়া হয়েছে।
চলতি মাসের ২ তারিখ থেকে শুরু করে তিন দিনের মধ্যে সেতুগুলো তৈরি করা হয়।
হাবিবুন নাহার আরও জানান, এই সেতু উল্লুক ব্যবহার করছে কি না তা বুঝতে সেতুগুলোর আশপাশে ক্যামেরা বসানো হয়েছে। সফলতা পাওয়া গেলে বনে এমন আরও কিছু সেতু করা হবে।
এই গবেষক দলের সদস্য সাবিত হাসান জানান, গত এক বছর ধরে তিনি ড. হাবিবুন নাহার ও ড. সাবির বিন মোজাফফরের তত্ত্বাবধানে লাউয়াছড়ার উল্লুকের সংখ্যা, পরিবারের বিন্যাস ও আচরণের উপর গবেষণা করছেন।
তিনি বলেন, রেল ও সড়ক পথে বনটি বিভক্ত থাকায় অনেক প্রাণী এক পাশের গাছ থেকে আরেক পাশের গাছে লাফ দিয়ে যেতে পারে না। কিছু প্রাণী নিচে নেমে সড়ক ও রেলপথ পাড়ি দেয়। তখন মারাও পড়ে। এই কৃত্রিম সেতু দিয়ে উল্লুকের পাশাপাশি অন্যান্য বানর প্রজাতি ও গেছো প্রাণী চলাচল করতে পারবে নিরাপদে।
২০১৯ সালে করা এক জরিপের কথা উল্লেখ করে সাবিত জানান, সে সময় তার পাওয়া তথ্য অনুসারে লাউয়াছড়া উদ্যানে আছে উল্লুকের ১৩টি পরিবার, যার সদস্য সংখ্যা ৪৩।
বন্যপ্রাণী গবেষক হাসান আল রাজী বলেন, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালে লাউয়াছড়া এবং সাতছড়ি বনে সড়ক দুর্ঘটনা এবং বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বানর জাতীয় প্রাণীর মৃত্যুর উপর একটা গবেষণা করা হয়।
তিনি বলেন, ‘এই গবেষণায় উল্লুকের মৃত্যুর কোনো প্রমাণ না থাকলেও সড়ক এবং রেলপথ এদের জন্য একটা বড় হুমকি। আমরা আশা করছি আমাদের এই উদ্যোগ উল্লুক ছাড়াও অন্যান্য বৃক্ষবাসী প্রাণীদের নিরাপদে সড়ক ও রেলপথ পারাপারে সহায়তা করবে।’
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘দেশের অন্যান্য জায়গা থেকে লাউয়াছড়া বনে উল্লুকের অবস্থান বেশ ভালো। এই সেতুগুলো লাউয়াছড়া বনের বানরজাতীয় প্রাণী, বিশেষ করে উল্লুকের জন্য খুবই উপকারী হবে বলে আমরা আশা করছি।
‘কিছুদিনের মধ্যে তারা অভ্যস্ত হয়ে যাবে এই সেতু দিয়ে চলাচলের জন্য। শতভাগ সফলতার পর দেশের অন্য বনেও এইসব সেতু নির্মাণ করা যেতে পারে।’