দেয়াল মাকড়সার জাল দিয়ে ভর্তি। বেঞ্চগুলো এলোমেলো করে রাখা। নষ্ট হয়ে পড়ে আছে কয়েকটি বই। ধুলোর আস্তরণে ভরা শ্রেণিকক্ষে বাসা বেঁধেছে পোকামাকড়। দেখে মনে হয় এখানে কখনও মানুষ প্রবেশ করেনি।
মঙ্গলবার এমন দৃশ্য দেখা গেল কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির কক্ষে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারি সিদ্ধান্তে দীর্ঘদিন বন্ধ রাখা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি।
একই চিত্র দেখা গেছে সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের চেরেঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও। এই বিদ্যালয়ের মাঠে আগাছা, পচে যাওয়া পাতা, গাছের ডালসহ ময়লা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির কক্ষ অগোছালো বেঞ্চ, পাতা আর ধুলার দখলে। প্রতিষ্ঠানের ওয়াশবক্লের চিত্র আরও ভয়াবহ। ল্যাট্রিন, বেসিন সবকিছুই অপরিষ্কার হয়ে রয়েছে।
ভূরুঙ্গামারী উপজেলার পাইকেরছড়া ইউনিয়নের ২ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও একই অবস্থা। কক্ষের দরজার তালায় মরিচা ধরেছে।
বিদ্যালয়টির চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আপেল বলে, ‘ক্লাসরুমে বৃষ্টির পানি পড়ে বেঞ্চ, মেঝে নষ্ট হয়ে গেছে। অবহেলায় পড়ে আছে সবকিছু। এমন অবস্থায় স্কুল খুললে ক্লাস করা সম্ভব নয়।’
হলোখানা দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বলে, ‘আমাদের ক্লাসরুমে মাকড়সা বাসা বেঁধেছে। রুমের অবস্থা দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। বন্ধ চলার সময় কখনোই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়নি। এই অবস্থায় প্রতিষ্ঠান খুললে কীভাবে আমরা ক্লাস করব?’
পাইকেড়ছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকার বাসিন্দা মজিবর রহমান বলেন, ‘সরকার তো স্কুলের জন্য ঠিকই বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু এই বন্ধের সময় বরাদ্দের টাকা কোথায় খরচ করল আমরা স্থানীয় মানুষ চোখে দেখি নাই। ঠিকমতো খরচ করলে স্কুলে ধুলাবালি জমত না।’
হলোখানা দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় এলাকার বাসিন্দা রজব আলী বলেন, ‘স্কুল খুললেও এখানে ক্লাস করার কোনো পরিবেশ নেই। এই বন্ধের সময় কোনো শিক্ষক বা কমিটির লোকজন স্কুলের কোনো খবরই রাখেনি।’
একই এলাকার মফিজ উদ্দিন বলেন, ‘শিক্ষকদের কাছে শিখবে সন্তানরা। অথচ স্কুলের জানালা দিয়ে দেখেন বিদ্যালয়ের বইগুলো কি নোংরা পরিবেশে রেখেছে। এমন অবস্থা যদি বিদ্যালয়ে হয় তাহলে সন্তানরা মানুষ হবে কীভাবে?’
চেরেঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকার বাসিন্দা শিল্পী রাণী বলেন, ‘স্কুল খুললে বাচ্চাদের জন্য সুবিধা। সরকারের স্কুল খোলার সিদ্ধান্তে আমরা খুশি। কিন্তু স্কুলের ক্লাসরুম ও বাথরুমের যে অবস্থা তাতে করে বাচ্চারা আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। স্কুল খোলার আগে সবকিছুই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হোক।’
বেসিনেও জমেছে ধুলার আস্তরণ
বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষক আবুল হোসেন বলেন, ‘আমরা নিয়মিত স্কুলে আসি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। এরপরেও বিদ্যালয় খোলার আগে আমরা সব স্বাস্থ্যসম্মত করে তুলব।’
এই বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘জেলায় ১ হাজার ২৪০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। বিদ্যালয় সার্বক্ষণিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হয়। এ জন্য পরিদর্শন কর্মকর্তা নিয়মিত বিদ্যালয় পরিদর্শন করছেন।
‘এ বিষয়ে শিক্ষকদেরও অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে। এরপরেও যদি কোনো বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে সেটি তদন্তসাপেক্ষে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
কুড়িগ্রামে নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৩৭৪টি। এর মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক ৮৯টি, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১০টি, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২৫৪টি এবং স্কুল অ্যান্ড কলেজ ২১টি। এ ছাড়া মাদ্রাসা ২২২টি, কলেজ ৬১টির মধ্যে সরকারি ১০টি এবং বেসরকারি ৫১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।
জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলম বলেন, ‘সরকারের দেয়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিদ্যালয় খোলার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। সরকারের নির্দেশনা পেলেই বিদ্যালয় খোলার এক সপ্তাহ আগেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হবে। সবকিছু পাঠদান উপযোগী করে তোলা হবে।’
বিদ্যালয়ের কক্ষে পড়ে আছে বইপত্র
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে আসায় ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এদিন থেকেই শ্রেণিকক্ষে শুরু হবে পাঠদান।
খোলার আগে ৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাঠদান উপযোগী আছে কি না তা যাছাই করতে নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।
দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। প্রাণঘাতী ভাইরাসটির বিস্তার রোধে ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এরপর দফায় দফায় বাড়ানো হয় ছুটির মেয়াদ। সর্বশেষ ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
ইতিমধ্যে মেডিক্যাল, ডেন্টাল ও নার্সিংবিষয়ক সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে খুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে সংশ্লিষ্টদের আগে থেকেই তাগিদ দিয়ে আসছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সবশেষ গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে তিনি বলেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্কুল খুলে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’
দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থী বিশেষ করে শিশুদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন মনোচিকিৎসকরা। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।
আর শিক্ষামন্ত্রী বলে আসছিলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সব প্রস্তুতি তাদের আছে। করোনা পরিস্থিতি আর একটু নিয়ন্ত্রণে এলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হতে পারে।
সম্প্রতি জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দেশের ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের ভাষ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যত বেশি সময় বন্ধ থাকবে, ততই বাড়বে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা।