মূল্যবান ধাতু ও খনিজে ভরা গ্রহাণু সিক্সটিন সাইকির মূল্যমান ১০ হাজার কোয়াড্রিলিয়ন ডলার। এক কোয়াড্রিলিয়ন মানে এক হাজার ট্রিলিয়ন, আর এক ট্রিলিয়ন মানে এক হাজার মিলিয়ন ডলার। তার মানে, এই সম্পদ পৃথিবীর মানুষকে ভাগ করে দিলে সবাই হয়ে যাবেন কোটিপতি।
বিপুল দামী সম্পদ সমৃদ্ধ গ্রহাণুটির উদ্দেশে নাসার যান রওনা হবে সামনের বছর। ২০২৬ সালে সেটি পৌছাবে সাইকিতে।সৌরজগতে মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মাঝে যে অ্যাস্টেরয়েড বেল্ট রয়েছে সেখানেই সাইকির অবস্থান। প্রায় ২০০ কিলোমিটার চওড়া এই গ্রহাণু অ্যাস্টরয়েড বেল্টের ১০ লক্ষাধিক গ্রহাণুর একটি।
ইতালিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানী আনিবাল দে গাসপারিস ১৮৫২ সালের ১৭ মার্চ সাইকি আবিষ্কার করেন। ধারণা করা হয়, সৌরজগতের সৃষ্টির সময় কোনো প্রোটোপ্ল্যানেটের সঙ্গে অন্য কোনো মহাজাগতিক বস্তুর সংঘর্ষে এর সৃষ্টি। গ্রিক দেবি সাইকির নামে গ্রহাণুটির নামকরণ করেন আনিবাল দে গাসপারিস। গ্রিক পুরাণে সাইকি আত্মার দেবী, যার সঙ্গে ভালোভাসার দেবতা ইরসের বিয়ে হয়েছে।যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসাডিনার ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক সাইকির তাপ মানচিত্র তৈরি করেছেন, যা থেকে এর পৃষ্ঠের উপাদান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে। সাধারণত মহাকাশের কোনো বস্তুর ইনফ্রারেড ছবিতে এক পিক্সেল রেজ্যুলিউশনের তথ্য বা ডেটা পাওয়া যায়। তবে চিলির আটাকামার লার্জ মিলিমিটার/সাবমিলিমিটার অ্যারে (আলমা) টেলিস্কোপ ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা ৫০ পিক্সেল রেজ্যুলিউশনের ডেটা পান। আর সেই টেলিস্কোপের ছবি থেকেই সাইকি গ্রহাণু সম্বন্ধে বিস্তারিত জেনেছেন বিজ্ঞানীরা। দেখা গেছে এর পৃষ্ঠটি ধাতব ও অন্তত ৩০ ভাগ বিভিন্ন ধাতু দিয়ে গঠিত। পৃষ্ঠের পাথরগুলোও ধাতব দানাযুক্ত।অন্যান্য গ্রহাণুর মতো পাথর বা বরফে তৈরি নয় সিক্সটিন সাইকি। মূলত এটি লোহা ও নিকেলের সংমিশ্রণে গঠিত। খনিজ মূল্যে এর দাম কয়েক হাজার কোয়াড্রিলিয়ন ডলার।ক্যালটেকের গবেষক দল গ্রহাণুটি থেকে নির্গত মিলিমিটার-ওয়েবলেংথ নিঃসরণের পরিমাপ করেছে। আর তা থেকেই তৈরি হয়েছে এর তাপ মানচিত্র। সাইকির মতো বিশেষ শ্রেণির গ্রহাণুকে বলা হয় এম-টাইপ। রহস্যময় এ ধরনের গ্রহাণুতে ধাতব পদার্থের পরিমাণ বেশি থাকে। ক্যালটেকের গ্রহবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক ক্যাথরিন ডে ক্লির বলেন, ‘শুরুর দিকে সৌরজগত অস্থির একটা জায়গা ছিল। গ্রহাণুগুলো একসঙ্গে জুড়তো বা একে অপরের সংঘর্ষ করে সূর্যের চারিদিকে নিজস্ব কক্ষপথ তৈরি করে ঘুরতে থাকত।‘আমাদের মনে হয় ওই গ্রহগুলোর কেন্দ্র, ভেতরের অংশ বা ভূত্বকের অংশগুলোই এখন গ্রহাণু হিসেবে টিকে আছে। তেমনটা হলে কোনো গ্রহের ভেতরটা কেমন ছিল সেটা নিয়ে গবেষণা করার একটা সুযোগ এসেছে আমাদের সামনে।’সাইকি পৃথিবী থেকে প্রায় ৩২ কোটি মাইল দূরে অবস্থিত। পৃথিবী থেকে এতদূরে অবস্থিত এত ছোট কোনো বস্তুকে নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানীদের সামনে চ্যালেঞ্জ।ক্যালটেকের সাভেরিও কাম্বিওনি বলেন, ‘নিম্ন তাপীয় জড়তার ক্ষেত্রে সাধারণত ধুলার আস্তরণ দেখা যায়, আর উচ্চ তাপীয় জড়তার ক্ষেত্রে পাথুরে পৃষ্ঠ চোখে পড়ে। যদিও এক ধরনের পৃষ্ঠ থেকে আরেকটি আলাদা করা মুশকিল।’পেনসিলভিনিয়ার ব্লুমসবার্গ ইউনিভার্সিটির মাইকেল শেপার্ডের সঙ্গে মিলে ডে ক্লির ও কাম্বিওনি চিলির ৬৬টি রেডিও টেলিস্কোপের সাহায্যে সাইকির পুরো পৃষ্ঠের ৩০ কিলোমিটারের একটি তাপ নির্গমন মানচিত্র তৈরি করেছেন।ডেটায় প্রতিটি পিক্সেল ৩০ কিলোমিটার X ৩০ কিলোমিটার। যা সবমিলে ৫০ পিক্সেলের একটি ছবি দিচ্ছে গ্রহাণুটির।গবেষণায় নিশ্চিত হওয়া গেছে, সাইকির তাপ জড়তা সাধারণ গ্রহাণু থেকে অনেক বেশি। ফলে এর পৃষ্ঠের ঘনত্ব অনেক বেশি।
ডি ক্লির বলেন, ‘আমরা বহু বছর ধরেই জানি, এই শ্রেণির বস্তুগুলো নিরেট ধাতব নয়। কিন্তু তারা কীভাবে গঠিত হয়েছে ও আসলে কেমন সেটা এখনও এক রহস্য।’গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য সাইকির জন্ম সম্বন্ধে একটি বিকল্প ধারণাও দেয়। এমনও হতে পারে, এটি আসলে কোনো প্রোটোপ্ল্যানেটের কেন্দ্রের অংশ নয়। বরং এটি পুরনো একটি গ্রহাণু যেটি সূর্যের কাছাকাছি কোনো স্থানে জন্ম নিয়েছিল।২০২৬ সালের শুরুতে সাইকির কাছে পৌঁছাবে নাসার প্রোব। ২১ মাস কক্ষপথে থেকে সেটি সাইকির বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করবে। এই কাজে মহাকাশ যানটি ব্যবহার করবে মাল্টিস্পেকট্রাল ইমেজার, গামা রশ্মি ও নিউট্রন মাপার জন্য স্পেকট্রোমিটার, ম্যাগনোমিটার ও অভিকর্ষ মাপার জন্য রেডিওভিত্তিক যন্ত্র।