গত পাঁচ বছরে ঢাকার বাতাস আরও বেশি বিষাক্ত হয়েছে। বায়ু দূষণের মাত্রা বেড়েছে গড়ে ১০ থেকে ২০ ভাগ। দিনে দূষণের চেয়ে ঢাকার রাতের বাতাসে দূষণের মাত্রা বেশি থাকে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি বছর ৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী নির্মল বায়ু দিবস পালিত হচ্ছে। ২০২০ সাল থেকে এটি পালিত হওয়া শুরু হয়েছে। এ বছর দ্বিতীয়বারের মতো পালন হচ্ছে দিবসটি।
তবে ঢাকা শহরে নির্মল বাতাস পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ‘আইকিউএয়ার’ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সূচকে দেখা যায়, বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ১০ শহরের একটি ঢাকা। মাঝে মাঝেই বেইজিং ও দিল্লিকে ছাপিয়ে সূচকে সবার উপরে উঠে আসে ঢাকার নাম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহরের আশপাশে গড়ে ওঠা ইটভাটা, শহরের মধ্যে মেগা প্রজেক্ট, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির কারণে ঢাকার আকাশে কখনও নির্মল বাতাসের দেখা মেলে না। ঢাকায় গত ১৬ বছরে মাত্র কয়েকদিনের জন্য নির্মল বাতাসের দেখা পাওয়া গিয়েছিল এ বছর জুলাই মাসে। আর সেটি সম্ভব হয় লকডাউন ও ঈদের ছুটির কারণে।
বাংলাদেশের জাতীয় আদর্শ বায়ু মান মাত্রা (অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণা ২.৫ বা পিএম ২.৫) প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে সর্বোচ্চ ৬৫ মাইক্রো গ্রাম নির্ধারণ করা হয়েছে। বস্তুকণা এর নিচে থাকলে ওই বায়ুকে নির্মল বায়ু হিসেবে ধরা হয়। সেই হিসেবে গত জুলাই মাসে নির্মল বায়ু পেয়েছে রাজধানীবাসী। কারণ, জুলাই মাসে ঢাকায় বায়ুতে পিএম ২.৫ ছিল ৩১.৩১ মাইক্রো গ্রাম।
এ বছর মার্চে বায়ু দূষণের মাত্রা অনেক বেশি ছিল। ডাব্লিউএইচওর মান অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ১০ মাইক্রোগ্রাম পিএম ২.৫ থাকলে তাকে সহনীয় বলা যেতে পারে। সেখানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, মঙ্গোলিয়া ও আফগানিস্তানে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পিএম ২.৫ ছিল ৭৭ থেকে ৪৭ মাইক্রোগ্রামের মধ্যে।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ডিন ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত পাঁচ বছর, অর্থাৎ ২০১৬ সালে থেকে যদি ধরি, তবে বায়ু দূষণের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। ২০২০ সালের মার্চের আগ পর্যন্ত দূষণ ক্রমাগত বাড়ছিল। মার্চের পর কোভিডকালীন এই মাত্রা কিছুটা কম ছিল।’
তিনি তাদের গবেষণার কথা তুলে ধরে বলেন, ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঈদ ঘিরে মোট ৫০ দিন ঢাকায় বায়ুর মান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৫০ দিনের মধ্যে ঢাকার মানুষ মাত্র ৬ দিন বিশুদ্ধ বায়ু সেবন করে। ২০১৭ সালের ঈদুল ফিতরের পরের দুই দিন বায়ুমান সূচক ছিল ৪২ ও ৩৬ এবং ২০১৯ সালের ঈদুল ফিতরের পরদিন বায়ুমান সূচক ছিল ৩৭; ২০১৯ সালে ঈদুল আজহার পরের দুই দিন বায়ুমান সূচক ছিল ৪৯ ও ২২; আর ২০২১ সালে ঈদুল আজহার এক দিন পর বায়ুমান সূচক ৪৪ ছিল।
এই অধ্যাপক বলেন, ‘২০২১ সালে এসে আবার বায়ু দূষণ বাড়তে থাকে। সাধারণত বছরের অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি এই চার মাস প্রায় ৭০ ভাগ বায়ু দুষণ হয়ে থাকে। আর জুন, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর – এই চার মাসে মাত্র ১০ ভাগ বায়ু দূষণ হয়। শুষ্ক মৌসুমে যে দূষণ হয়ে থাকে, সেটা যদি আমরা কমিয়ে আনতে পারি, তবে একটা জায়গায় দাঁড়াতে পারব।’
কখন বেশি দূষণ ঘটে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ু দূষণ বিষয়ক গবেষক অধ্যাপক আবদুস সালাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দূষণ প্রতিনিয়তই বাড়ছে। বায়ুর মানের মাত্রা যেমন থাকা উচিত, সেখানে শীতকালে ১০ থেকে ২০ ভাগ দূষণের মাত্রা বেশি থাকে। বর্ষার সময় কিছুদিন মাত্রার মধ্যে দূষণ থাকলেও বাকিটা সময় দূষিত থাকে।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকায় দিনের চেয়ে রাতে দূষণ বেশি থাকে। সকালে অফিস আদালত চালু হয়, তখন দূষণ বাড়ে। আবার দুপুরে কম থাকে। আবার সন্ধা বেলা বাড়ে। তবে মধ্যরাতে দূষণ থাকে সবচেয়ে বেশি।’
ধুলায় ঢেকে আছে রাজধানীর বনশ্রী এলাকা। ছবি: সাইফুল ইসলাম/নিউজবাংলা
মধ্যরাতে দূষণ বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আহমদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘এ সময় আন্তঃজেলা বাসগুলো শহরের উপর দিয়ে যাতায়াত করে। নির্মাণ সামগ্রী ট্রাকে করে রাতের বেলায় পরিবহণ করা হয়। দিনের বেলায় গাড়ির গতি কম থাকায় রাস্তার ধুলা কম ওড়ে। রাতে একটা বাড়ে।’
দূষণ বাড়ছে প্রতি বছর
প্রতি বছর পূর্ববর্তী বছর থেকে ১০ থেকে ২০ ভাগ বায়ু দূষণের মাত্রা বাড়ছে। ২০২০ সালের সাথে ২০২১ সালের তুলনা করলে দেখা যাবে: ২০২০ এর জানুয়ারি থেকে ২০২১ এর জানুয়ারিতে দূষণ বেড়েছে ২৫ ভাগ। ফেব্রুয়ারিতে এটি বাড়ে ১০ ভাগ, মার্চ মাসে ৩৬ ভাগ। শুধুমাত্র জুলাই মাসেই গত বছরের তুলনায় দূষণ ১০ থেকে ১২ ভাগ কমেছিল।
ঢাকায় বায়ু দূষণের কারণ
এক সময় ঢাকায় বায়ু দূষণের সবচেয়ে বড় উৎস ছিল ইটের ভাটা। প্রায় ৫৮ ভাগ বায়ু দূষণ ঘটত ইটের ভাটা থেকে। কিন্তু এখন ইটের ভাটার দূষণকে ছাড়িয়ে গেছে নির্মাণ এবং গাড়ির ধোঁয়া। সড়ক নির্মাণ ও মেগা প্রজেক্টের কারণে প্রায় ৩০ ভাগ বায়ু দূষণ হচ্ছে। ইটের ভাটা থেকে এখন ৩০ ভাগ, যানবাহন থেকে ১৫ ভাগ, বর্জ্য পোড়ানো থেকে ৯ ভাগ দূষণ হয়।
তবে বায়ুদূষণের আরেকটি উৎসের কথা উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান। সেটি হলো আন্তঃদেশীয় দূষণ। এক দেশের দূষিত বায়ু আরেক দেশে দূষণ ঘটায় বায়ুপ্রবাহের কারণে। ঢাকায় আন্তঃদেশীয় কারণে ১০ ভাগ বায়ু দূষণ হয়ে থাকে বলে গবেষণায় দাবি করা হয়েছে।
আহমদ কামরুজ্জামান বলেন, যেসব এলাকায় মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ চলছে, সেখানে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, নির্মাণবিধি মেনে কাজ হচ্ছে না। নির্মাণসামগ্রী রাস্তার ওপর থাকা ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে বায়ু দূষণ বাড়ে। তবে আশা করা যাচ্ছে, মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দূষণের মাত্রা কমবে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের যে ১৯৯৭ সালের মান নির্ধারণ করা আছে, তা অনুযায়ী, শুষ্ক মৌসুমে বায়ু প্রায় ১০ গুণ বেশি দূষিত হয়।’
অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, ‘আমাদের গাড়িগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণ ধোঁয়া আসে। আমাদের আশপাশের কারখানা, নির্মাণকাজ আর যেসব ময়লা আগুনে পোড়ানো হয়, সেখান থেকেও ধোঁয়া আসে।’
এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমরা যদি পদক্ষেপ নেই, তবেই নির্মল বাতাস আশা করতে পারি। পৃথিবীর অনেক দেশ আমাদের চেয়ে বেশি দূষিত ছিল। আমেরিকায় ৭০ থেকে ৮০ বছর আগে আমাদের মতো অবস্থা ছিল। লন্ডন বা জাপানেও এমন ছিল। এখন আমাদের চেয়ে শীতকালে ১০০ গুণ কম থাকে তাদের দূষণ। তারা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।’
বায়ু দূষণ কমবে ২০২৩ সালের পর?
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক আশা করছেন, ২০২৩ সালের পর বায়ু দূষণের মাত্রা কমে আসবে।
এর কারণ ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের দূষণের যে উৎস রয়েছে, সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের প্রধান কাজ। আর প্রধান উৎস হচ্ছে ইটভাটা। সরকার থেকে প্রজ্ঞাপণ জারি হয়েছে, পোড়ানো ইট দিয়ে আর কোনো সরকারি নির্মাণকাজ হবে না। ২০১৯-এর অক্টোবরে এটি হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, ২০২৫-এর মধ্যে রাস্তা ছাড়া সব নির্মাণ কাছে হবে পরিবেশবান্ধব ব্লক দিয়ে।’
তিনি বলেন, ‘ইট থেকে সরে আসার চেষ্টা হচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এ ব্যাপারে একটা লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয়া হবে। আমরা ইট ভাটার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছি। দেশে ৮ হাজার ইটভাটা আছে। এখন সেটা কমে আসবে। আমরা আশা করছি, ২০৩০ সালের সনাতন পদ্ধতির ইট ভাটা ২০ ভাগে নিয়ে আসতে পারব।’
নির্মাণ কাজে বিধি না মানার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমরা মেগা প্রকল্পের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিচ্ছি। পরিবেশ বিধিমালা এই বছরের জানুয়ারিতে সংশোধন করা হয়েছে। সেখানে নির্মাণবিধিমালা না মানার ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে মোবাইল কোর্ট করা যাবে। এটা গেজেট হয়েছে।’
বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০২১ তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে জিয়াউল হক বলেন, ‘এটা মন্ত্রণালয়ে ভেটিং পর্যায়ে আছে। আগামী মাসের মধ্যেই এটা পেয়ে যাব, সেখানে অনেক কিছুই সংযুক্ত করা হবে। তবে আশা করছি, ইট ভাটা নিয়ন্ত্রণ ও মেগা প্রজেক্টের কাজ যেহেতু ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হবে, তাই ২০২৩ সালে বায়ু দূষণ কমার ক্ষেত্রে উন্নতি দেখতে পাব।’