বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

এমপি বাবলু: বিতর্কই যার সঙ্গী

  •    
  • ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১০:১৪

উপজেলা নির্বাচনে ১৭ ভোট পাওয়া এই প্রার্থী গত জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির সমর্থন পেয়ে যান অপ্রত্যাশিতভাবেই। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও পরে বিএনপির আরেক নেতার প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যাওয়ার পর আসনটি বিএনপির প্রার্থী শূন্য হয়ে যায়। সে সময় স্থানীয়ভাবে গোলবাগী হিসেবে পরিচিত বাবলুকে সমর্থন জানায় বিএনপি। ভোটের পরেই ভোল পাল্টে ফেলেন তিনি। বিএনপির শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন তিনি।

চাকরিজীবী নারী-পুরুষের মধ্যে বিয়েতে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে তোলপাড় ফেলা আসা বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনের সংসদ সদস্য মো. রেজাউল করিম ওরফে বাবলুকে নিয়ে বিতর্ক কোনো নতুন ঘটনা নয়।

হঠাৎ করেই ঘটনাচক্রে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে যাওয়া, যারা তাদেরকে জিতিয়েছিলেন, ভোটের পর পরই তাদেরকে অস্বীকার করা, বেফাঁস মন্তব্য, বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বারবার সমালোচনা হচ্ছে তাকে নিয়ে।

অভিযোগ আছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের দাখিল করা হলফনামায় তথ্য গোপন করেছেন।

তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে একটি মামলা আছে বগুড়ার বিচারিক আদালতে। এই মামলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দেয়া হয়েছে। এই তথ্য তিনি চেপে গেছেন।

স্থানীয়ভাবে গোলবাগী নামে পরিচিত এই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার দুই মাসের মাথায় মোটরসাইকেল থেকে নোয়াহ হাইব্রিড গাড়ি কিনে আলোচনায় আসেন। পিস্তল উচিয়ে ফেসবুকে ছবি দেয়া আর বক্তব্য দিয়ে বারবার আলোচনায় এসেছেন তিনি।

তিনি এমপি যেভাবে

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান গাবতলী ও পাশের উপজেলা শাজাহানপুর নিয়ে গঠিত বগুড়া-৭। আসনটি ‘জিয়া পরিবারের আসন’ হিসেবেই পরিচিত।

বিএনপির দূর্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও কখনও ভাগ বসাতে পারেনি। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সব জাতীয় নির্বাচনেই এ আসনে বিপুল ভোটে জয়ী হন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সাজাপ্রাপ্ত আসামি হওয়ায় গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি তিনি।

আসনে বিএনপির মনোনয়ন পান গাবতলীর বিএনপি নেতা ও উপজেলা চেয়ারম্যান মোরশেদ মিলটন। কিন্তু তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। আসনটিতে নির্বাচন হয় বিএনপির প্রার্থী ছাড়া।

এ অবস্থায় ভোটের এক দিন আগে স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল করিম গোলবাগীকে সমর্থন দেয় গাবতলী ও শাজাহানপুর বিএনপি। ট্রাক প্রতীক নিয়ে তিনি জয়ী হন। এ জন্য স্থানীয়রা বলে থাকেন, রেজাউল করিম গোলবাগী সংসদ সদস্য হয়েছেন কপাল গুণে।

বাবলুর ব্যক্তিগত সমর্থন ওই এলাকায় কতটা, সেটি বোঝা যায় উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলে। সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় ওই নির্বাচনে তিনি ১৭ ভোট পেয়েছিলেন।

ওই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনা বিএনপি থেকে নির্বাচিতরা সে সময় শপথ না নেয়ার ঘোষণা দিলেও বাবলু সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন।

হলফনামায় তথ্য গোপন

নির্বাচন কমিশনের হলফনামার ৩ এর ‘ক’ ধারায় বলা হয়েছে, অতীতে প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা আছে কী না, থাকলে তার ফলাফল উল্লেখ করতে হবে। উল্লেখ করতে হবে যে আইন ও ধারায় মামলা হয়েছে। কোন থানায় মামলা হয়েছিল। মামলার নম্বর এবং মামলার ফলাফল।

বাবুল হলফনামায় দাবি করেছেন, তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা ছিল না। কিন্তু তার বিরুদ্ধে মামলা থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর এই বিষয়টি তিনি গোপন করেছেন।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এর ১২ (৩ বি) অনুচ্ছেদ অনুসারে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব প্রার্থীকে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামার মাধ্যমে আটটি তথ্য এবং কোনো কোনো তথ্যের সাপেক্ষে কাগজপত্র দাখিল করতে হবে। এই আইন মতে, হলফনামায় প্রদত্ত কোনো তথ্য মিথ্যা বা ভুল বলে প্রমাণিত হলে তা ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ১৮১ ধারা অনুযায়ী তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেয়া মানেই তো তিনি নির্বাচনে অযোগ্য ব্যক্তি। এখন বিষয়টি আদালতের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ আছে। ওই সাংসদের বিরুদ্ধে তথ্য গোপনের বিষয়টি আদালতের মাধ্যমে প্রমাণ করা গেলে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে।’

বাবুলের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের মামলা করেন আবু হায়াত নামের এক ব্যক্তি। তার বাড়ি শাজাহানপুর উপজেলার গোয়ালগাছা গ্রামে। মামলার আসামি করা হয় শওকত আলী গোলবাগী ওরফে বাবলুকে। তার বাবা মৃত মুইন উদ্দিন গোলবাগী। গ্রাম ডোমনপুকুর। শাজাহানপুর উপজেলা। এই শওকত আলী গোলাবাগী ওরফে বাবলুই বর্তমান সাংসদ মো. রেজাউল করিম গোলবাগী।

মামলার সংক্ষিপ্ত এজাহারে থেকে জানা গেছে, শওকত আলী গোলবাগী ওরফে বাবলু (শওতক আলী গোলবাগী) ২০০৭ সালে শাজাহানপুর উপজেলার মাঝিড়া কারিগরি উচ্চ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। ওই সময় বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।

মামলায় বলা হয়, চাকরি দেয়ার নাম করে আবু হায়াতের কাছ থেকে ২০০৭ সালের ৭ মার্চ ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা নেন গোলবাগী। কিন্তু শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়নি। টাকাও ফেরত দেননি তিনি।

২০০৭ সালে শওকত আলীর বিরুদ্ধে শাজাহানপুর থানায় মামলা করেন আবু হায়াত। এরপর ২০০৭ সালে আদালতে ৪০৬/৪২০ ধারায় অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে শওকত আলী গোলবাগী ওরফে বাবলুকে একমাত্র আসামি হিসেবে পলাতক দেখানো হয়।

মামলার বিষয়ে আবু হায়াত বলেন, ‘এই বাবলু চাকরি দেওয়ার নাম করে অনেকের কাছ থেকেই টাকা নিয়েছেন। টাকা উদ্ধারের মামলা করে মামলা চালাতে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে।’

আগের জায়গাতে মাঝিড়া কারিগরি উচ্চ বিদ্যালয়ও আর নেই। এখানে ‘দারুল ফাতাদ মাদ্রাসা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও প্রধান শিক্ষক বলেন, তার মাদ্রাসা হওয়ার আগে মাঝিড়া কারিগরি উচ্চ বিদ্যালয় ছিল।

হলফনামায় মামলার তথ্য গোপনের বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ রেজাউল করিম বলেন, ‘হলফনামায় আমি তথ্য দিয়েছি কিনা এ বিষয়ে আমার এখন কিছু মনে নেই। কাগজপত্র দেখে বলতে পারব।’

হলফনামায় এমন তথ্য দেয়ার বিষয়ে তৎকালীন রিটার্নিং কর্মকর্তা ও বগুড়ার সাবেক জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহাম্মদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হলফনামা যাচাইকালে কেউ অভিযোগ করেনি। রেজাউল করিম এখন সাংসদ হয়েছেন। মিথ্যা তথ্য দেওয়ার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আমাদের মামলা করার সময়ও শেষ হয়েছে। এখন আমাদের কিছু করার নেই। তবে এই বিষয়ে অন্য কেউ ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে পারেন। তখন বিষয়টি আদালত দেখবে।’

শওকত আলী গোলবাগীই রেজাউল করিম গোলবাগী

সাংসদ রেজাউল করিম শাজাহানপুরের বাড়ির নাম ‘গোলবাগী মঞ্জিল’। সাংসদের বাড়ি ডোমনপুকুর মৌজায়। এই মৌজায় পৌনে পাঁচ শতাংশ জমি সাংসদ কিনেছেন ২০০৩ সালে। জমির সাবেক দাগ নম্বর ১২১৬। হাল দাগ ১৩৭৭। ধরন ভিটা। ১৯ শতাংশ জমির কাতে সাংসদ কিনেছেন পৌনে পাঁচ শতাংশ জমি।

জমির মূল মালিকরা হলেন ডোমনপুকুর এলাকার মোছা. শাহনাজ বেগম ওরফে নমিতা, মোছা. আছমা বেগম, মোছা. আছিয়া বেগম ও মোছা. রাজিয়া সুলতানা।

জমি ক্রেতারা হলেন, মো. রেজাউল করিম গোলবাগী ওরফে শওকত আলী গোলবাগী (বাবলু)। রেজাউল করিমের পিতা মৃত ময়েন উদ্দিন গোলবাগী। জমির আরেকজন ক্রেতার নাম মোছা. বিউটি বেগম। তিনি রেজাউল করিম গোলবাগী ওরফে শওকত আলী গোলবাগীর স্ত্রী। তাদের বাড়ি ডোমনপুকুর এলাকায় উল্লেখ করা হয়েছে।

২০০৩ সালে শাজাহানপুরে কোনো জমি নিবন্ধন কার্যালয় ছিল না। তখন বগুড়া সদরে জমি নিবন্ধন কার্যালয়ে শাজাহানপুরের জমি নিবন্ধন করা হতো। এই দলিল সত্যতা বগুড়া সদর নিবন্ধন কার্যালয়ের নথি যাচাই করে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

শাজাহানপুর প্রেস ক্লাবের বর্তমান সভাপতি শাহাদত হোসেন। সাংসদ রেজাউল করিম এই প্রেস ক্লাবের সদস্য ছিলেন কি না জানতে চাইলে শাহাদত হোসেন বলেন, ‘শাজাহানপুর প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠাতা শওকত আলী গোলবাগী ওরফে বাবলু। তিনিই বর্তমান সাংসদ রেজাউল করিম বাবলু। সভাপতির তালিকায় এখনো তাঁর নাম টাঙানো রয়েছে।’

দুই মাসেই ভাগ্য বদল

গত সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় মাসিক আয় ৪১৭ টাকা দেখান রেজাউল করিম বাবলু। নির্বাচনে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হিসেবে জয়ী হওয়ার দুই মাসের মধ্যে গাড়ি (নোয়াহ হাইব্রিড) কিনে আলোচনায় আসেন তিনি।

এই বিষয়টি আমলে নিয়ে গত মার্চ মাসের শুরুতে তার সম্পদের প্রাথমিক তথ্য চেয়ে নোটিশ পাঠায় দুদকের বগুড়া আঞ্চলিক কার্যালয়। চিঠিতে ১৪ মার্চের মধ্যে হাজির হয়ে সম্পদের প্রাথমিক হিসাব দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়।

নোটিশের পরে ১৪ মার্চ তিনি বগুড়ার দুদক কার্যালয়ে যান। তবে সেদিন কোনো তথ্য জমা দেননি। রেকর্ডপত্র গোছানো না থাকার অজুহাত দেখিয়ে সম্পদের হিসাব জমা দিতে দুদকের কাছে সময় চান তিনি।

সেদিন তিনি বলেন, ‘আমি কাগজপত্র প্রমাণসহ আগামী তারিখে লিখিত জবাব দাখিল করব। দুদক কর্মকর্তারা আপাতত মৌখিকভাবে সময় দিয়েছেন।’

পরে দুদক তাকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত সময় দেয় সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দেয়ার জন্য। এরপর তিনি তার সম্পদের প্রাথমিক নথি দুদকে জমা দেন।

জানতে চাইলে রেজাউল করিম বাবলু বলেন, ‘সর্বশেষ আমি যে সাত দিনের সময় নিয়েছিলাম তখনই সম্পদের হিসাব দিয়েছি।’

বগুড়া দদুকের সহকারী পরিচালক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘সাংসদ তার সম্পদের প্রাথমিক হিসাব বিবরণী জমা দিয়েছেন। এই রিপোর্ট খুব দ্রুত দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জমা দেয়া হবে।’

আগের বেফাঁস মন্তব্য

গত বছরের ১৭ নভেম্বর সংসদে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) বিল-২০০০’ সংসদে পাস হওয়ার সময় রেজাউল করিম বলেছিলেন, ‘নারীবাদীরা নারী স্বাধীনতার কথা বলে নারীদের উন্মুক্ত করে চলছে। এ কারণেই ধর্ষকেরা ধর্ষণের অনুভূতিকে এতটা একসেপ্ট করেছে, ধর্ষণে উৎসাহিত হচ্ছে।’

অস্ত্র হাতে ভাইরাল

রেজাউল করিম গোলবাগীর একটি ছবি গত বছরের অক্টোবরে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ছবিতে দেখা যায়, হাতে অস্ত্র নিয়ে হাসিমুখে একটি চেয়ারে বসে আছেন তিনি। পাশের টেবিলে আছে গুলির ম্যাগজিন। ছবিটি ভাইরাল হওয়ার পর নতুন করে আলোচনায় আসেন গোলবাগী।

এ বিভাগের আরো খবর