লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের সাহাপুর এলাকার মৃত তনু মিয়ার ছেলে আয়াত উল্যাহ। বয়স্ক ভাতার কার্ডধারী আয়াত গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকে নিজের হিসাব থেকে নিয়মিত ভাতার টাকা পেয়েছেন। তবে অক্টোবর থেকে ভাতার টাকা বিকাশের মাধ্যমে দেয়া শুরু হতেই তৈরি হয় জটিলতা। আয়াত উল্যাহর মতো জেলার পাঁচ শতাধিক বয়স্ক মানুষের সরকারি ভাতা চলে গেছে অন্য অ্যাকাউন্টে।
এসব মানুষের অভিযোগ, জেলা ও উপজেলার সমাজসেবা কার্যালয়ে গিয়েও কোনো সমাধান হচ্ছে না। যে পরিমাণ ভাতা পাওয়ার কথা বিভিন্ন অফিসে ঘুরতে ঘুরতে তার তিন গুণ বেশি টাকা খরচ হয়ে গেছে।
লক্ষ্মীপুর শহর সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, তিন মাস পর পর বয়স্ক ভাতাভোগীরা তাদের মোবাইল ফোন নম্বরে বিকাশের হিসাব থেকে খুদে বার্তা ও টাকা পান। এসব ভাতাভোগীর জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভারের সঙ্গে সমাজসেবার সার্ভারের আইডি লিংক রয়েছে। তবে মোবাইল ফোন নম্বরে ভুলের কারণে জেলার কয়েক শ ভাতাভোগী ভোগান্তিতে পড়েছেন।
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. নুরুল ইসলাম পাটওয়ারী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মোবাইল নম্বরের ভুলের কারণে জেলায় পাঁচ শতাধিক মানুষ ভাতা পাচ্ছেন না। এই জেলায় বিকাশের মাধ্যমে টাকাগুলো পাঠানো হয়। ১ লাখ ১৬ হাজার ১০০ মানুষের মধ্যে ৫ শতাধিক বয়স্ক মানুষ সমস্যায় পড়েছেন। ইতিমধ্যে এসব ব্যক্তির তালিকা করে এবং নতুন মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে আবার পাঠানো হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’
নিউজবাংলার জেলা প্রতিনিধিদের তথ্য অনুযায়ী, শুধু লক্ষ্মীপুরে নয়, সারা দেশেই মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে বয়স্ক ভাতার টাকা পাঠাতে গিয়ে তৈরি হয়েছে জটিলতা।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বেলকা গ্রামের মৃত উরুকেশু মিয়ার স্ত্রী আলেকজান বেওয়া ৯ বছর ধরে বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। তবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে (নগদ) টাকা বিতরণ শুরুর পর থেকে গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই কিস্তির টাকা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন তিনি।
জেলা সদর, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় দুই দফার ভাতার অর্থ না পেয়ে সম্প্রতি স্থানীয় সমাজসেবা কার্যালয়ে অভিযোগ জানান ভাতাভোগীরা। বিষয়টি সমাজসেবা অধিদপ্তর পর্যন্ত পৌঁছালে কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তবে কমিটির এক সদস্য করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় থমকে রয়েছে কার্যক্রম।
গাইবান্ধা জেলায় ২ লাখ ৪০ হাজার ৭৮ জন বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় আছেন। তাদের মধ্যে হাজারের বেশি মানুষ এ সমস্যায় পড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিষয়টি দুঃখজনক উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মতিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনাটি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। এটা সমাধান হয়ে যাবে।’
পটুয়াখালী পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের নবাবপাড়ায় থাকেন বৃদ্ধ গাজী জামাল উদ্দিন। তার বয়স্ক ভাতার টাকা চলে গেছে অন্যের অ্যাকাউন্টে।
জামাল উদ্দিন নিউজবাংলাকে জানান, তার ব্যবহৃত ফোন নম্বরে নগদ অ্যাকাউন্ট খুলে দেন পৌর এলাকার সমাজসেবার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার মো. মেহেদি হাসান। অনেক দিন অপেক্ষার পর টাকা না পেয়ে অফিসে যোগাযোগ করলে তাকে জানানো হয়, গত ১ জুন তিন হাজার এবং একই মাসের ১২ তারিখে আরও দেড় হাজার টাকা মন্ত্রণালয় থেকে তার অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়েছে।
১০ আগস্ট আবার সমাজসেবা কার্যালয়ে যান জামাল উদ্দিন। এর পরদিন জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক শিলা রানী জানান, তার নম্বর ক্লোন করে চট্টগ্রামের নুর মদিনা ফার্মেসির সৈয়দ মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন নামের একজন টাকা তুলে নিয়েছেন।
শিলা রানী দাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পটুয়াখালীর আটটি উপজেলা থেকে মোট ৭৩টি আবেদন পাওয়া গেছে। তারা নিজেদের নামের বরাদ্দ টাকা মোবাইল থেকে তুলতে পারেননি। বিষয়টি আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অবহিত করেছি। আশা করছি খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভুক্তভোগীরা তাদের টাকা পাবেন।’
শরীয়তপুর সদর উপজেলার আংগারিয়া ইউনিয়নের উত্তর ভাষানচর গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী আওলাদ হোসেন মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলার পর ভাতার কোনো অর্থ পাননি। সদর উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে দিনের পর দিন ঘুরেও কোনো লাভ হয়নি।
উপজেলার বিনোদপুর পশ্চিমপাড়া গ্রামের সরবানু বেগমও পাচ্ছেন না বিধবা ভাতা। আক্ষেপ করে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাংকেই বালো ছিল। হ্যারা মোবাইল নম্বর চাইছে। আমরা পরিষদে গিয়া বাড়ির মোবাইল নম্বর দিছি। কী বুল (ভুল) অইছে আমরা তো জানি না। আমাগো ভাতার ট্যাহা চাই।’
কেন এমন অবস্থা
দরিদ্রদের বিভিন্ন ভাতার বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে থাকা সমাজসেবা অধিদপ্তর বলছে, দেশের প্রায় ৮৮ লাখ মানুষ বিভিন্ন ধরনের ভাতা পাচ্ছেন। বয়স্ক ও বিধবারা প্রতি মাসে সরকারের কাছ থেকে ৫০০ টাকা এবং প্রতিবন্ধীরা মাসে ৭০০ টাকা করে ভাতা পান। আগে ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে এ টাকা জমা হলেও এখন তা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠানো হচ্ছে। সাধারণত প্রতি তিন মাসের টাকা একসঙ্গে পাঠানো হয়।
অধিদপ্তরের দাবি, একজনের টাকা অন্যের কাছে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে এনআইডি, মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের মোবাইল নম্বর এবং নামের ভুলের কারণে টাকা নাও যেতে পারে। এনআইডি নম্বর ভুল হলে, অ্যাকাউন্টে ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর ভুল হলে অথবা নামের বানানে ঝামেলা থাকলে টাকা ফেরত আসে। তবে ভুক্তভোগীরা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে গেলেই সমস্যার সমাধান করে দেয়া হচ্ছে।
অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সুবিধাভোগীর আপনজনরা অনেক সময় টাকা তুলে নেন। কারণ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগীদের অনেকেরই নিজস্ব মোবাইল নম্বর, বা মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট নেই। সে ক্ষেত্রে তারা আপনজনের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করেন।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা) মো. সাব্বির ইমাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিশাল সংখ্যার মাঝে কিছু সমস্যা থাকতে পারে, তবে তা একেবারেই নগণ্য। এসব সমস্যা স্থানীয়ভাবেই প্রতিকার করা হচ্ছে। তাছাড়া কোনো ভুক্তভোগী যদি টাকা না পান, তার মানে টাকা অন্যের কাছে চলে গেছে এমন নয়। তথ্যের গরমিলের কারণে টাকা ফেরত যেতে পারে। পরে তিনি সমস্যা নিয়ে স্থানীয় অফিসে গেলে টাকা অবশ্যই পাবেন।
‘আমাদের সুবিধাভোগীরা অনেক বয়স্ক মানুষ। এত দিন সাধারণভাবে ব্যাংকের মাধ্যমে তারা টাকা পেতেন। ব্যবস্থা ডিজিটালাইজ করার কারণে হয়তো একটু সাময়িক সমস্যা হচ্ছে। এটা কেটে যাবে।’
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি আব্বাস হোসেন, গাইবান্ধা প্রতিনিধি পিয়ারুল ইসলাম, শরীয়তপুর প্রতিনিধি কাজী মনিরুজ্জামান ও পটুয়াখালীর প্রতিনিধি জাকারিয়া হৃদয়।]